১৫১ বার পড়া হয়েছে
প্রাচুর্য এবং দারিদ্র
কাজী জহিরুল ইসলাম
পৃথিবীতে দুটো সংস্কৃতি আছে, প্রাচুর্যের সংস্কৃতি এবং দারিদ্রের সংস্কৃতি, ইংরেজিতে বলে কালচার অব প্লেন্টি এবং কালচার অব পভার্টি। লক্ষ করে দেখবেন দারিদ্রের সংস্কৃতিতে যাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তারা যতো ধনীই হোন না কেন, আচরণে দারিদ্রের ছাপ থাকবেই। যেমন ভারতের আম্বানি পরিবার। তাদের অতি বিলাসবহুল বাড়ি, শত শত চাকর-বাকর, কোটি টাকার ঘড়ি, সোনায় মোড়ানো গাড়ি, বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা, খাবারের মেন্যুতে হাজার খানেক পদ রাখা, এইসবই হচ্ছে দারিদ্রের লক্ষণ বা ইন্ডিকেটর। দারিদ্রের সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষের আজন্ম প্রচেষ্টা থাকে দারিদ্র্য লুকোনো, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে এমনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে যাতে লোকেরা তাদের দরিদ্র না বলে। যতোটা পারে তারা নিজেদের বিত্তের জৌলুশ মানুষকে দেখায়। দারিদ্রের সংস্কৃতিতে আরো একটি বৈশিষ্ট্য দেখবেন, সেটি হচ্ছে ছোটো-বড়ো যে কোনো উৎসব, আয়োজনের কেন্দ্রে থাকে খাবার। কে কত দামী এবং অধিক পরিমানে খাবারের সমারোহ ঘটাতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা চলে। দরিদ্র দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো দাপ্তরিক মিটিং হয় না খাবার ছাড়া। কেউ কারো বাড়িতে গেলে, সেটা যে কোনো সময়েই হোক, কিছু না কিছু খেয়ে যেতে হবে, কারো বাড়ি থেকে ফিরে এলে, পরিবারের অন্যরা জিজ্ঞেস করে, কী খেতে দিয়েছে? খাবার হচ্ছে একটি প্রধান মানদণ্ড। দারিদ্রের সংস্কৃতিতে যেসব ধনকুবের আছেন তাদের মানব হিতৈষী চ্যারিটি করতে তেমন দেখা যায় না। তারা মাঝে-মধ্যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দান-খয়রাত করেন, তারা মনে করেন এইসব প্রতিষ্ঠানে দান করার মধ্য দিয়ে পরকালের সুখ কিনতে পারছেন।
আমি জানি না, আম্বানি পরিবারের বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানের জমকালো এবং ব্যয়বহুল আয়োজন আপনাদের কার কাছে কেমন লাগে, আমার কাছে নিতান্তই ছেলেমানুষী এবং হাস্যকর লাগে। বাংলাদেশে একজন স্বঘোষিত ধনকুবের আছেন, তার নাম মূসা বিন শমশের। তার নাকি হীরকখচিত জুতো আছে অনেক জোড়া। তিনি নিজেই নিজের নামের আগে প্রিন্স, মানে রাজপুত্র উপাধি যুক্ত করেছেন। তাকে হয়ত কেউ বলেনি যে এই শব্দটির একটি অর্থ আছে। লোকটি কেমন হাস্যকর দেখেন, তিনি নাকি নিজের হাতে খাবার খেতে পারেন না, তাকে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। জুতো পরিয়ে দিতে হয়। আমি ঠিক জানি না, পায়ুপথ নোংরা হলে তিনি তা নিজেই সাফ করেন নাকি সেটাও অন্য কেউ করে দেয়। এডি মর্ফি অভিনীত একটি সিনেমা দেখেছিলাম, তিনি ছিলেন একজন আফ্রিকান রাজপুত্র। সুইমিং পুলে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন, এক সুন্দরী তার সামনে ডুব দেন, একটু পরে উঠে এসে বলেন, দ্য রয়েল পিনাস ইজ ক্লিন ইওর হাইনেস। এই ছবিটি আমাদের মূসা সাহেব দেখে থাকলে আমি নিশ্চিত তিনিও এইভাবে তার শিশ্ন সাফ করাবেন অন্য কাউকে দিয়ে। এর সবই হচ্ছে পৃথিবীকে জানানো যে, দেখো আমি ধনী হয়েছি, আমাকে আর কেউ দরিদ্র বলবে না।
কালচার অব পভার্টি এবং কালচার অব প্লেন্টি দুটো সংস্কৃতিতেই কর্মসূত্রে বসবাস করার সুযোগ ঘটেছে আমার। নানান কারণে এই দুই সংস্কৃতির, পৃথিবীর নানান অংশে, গভীরে ঢোকারও সুযোগ ঘটেছে। খুব কাছে থেকে দেখেছি আচরণগত পার্থক্য। প্রাচুর্যের সংস্কৃতিতেও প্রচুর ধনী মানুষ আছেন, তাদের চেষ্টা থাকে বিত্তের জৌলুশ লুকিয়ে সাধারণ জীবন যাপন করা। ওয়ারেন বাফেটের পুরনো গাড়ি চালানো, পুরনো বাড়িতে থাকা, ম্যাক বার্গার দিয়ে লাঞ্চ করার গল্প তো আমরা জানিই, বিল গেটস লাইনে দাঁড়িয়ে স্টার বাক্সের কফি কেনেন, মার্ক জাকারবার্গ টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ান এইসব নিয়ে ভারতের কোনো কোনো সাংবাদিক বলার চেষ্টা করেন এগুলো লোক দেখানো, প্রচার পাবার জন্য তারা এটা করেন, আমি তা বিশ্বাস করি না। করি না এজন্য, শুধু এই ক’জন ধনী মানুষই নয় আমি প্রাচুর্যের সংস্কৃতিতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আরো বহু মানুষের মধ্যেই এই অভ্যাস দেখেছি। তারা ক্ষমতা দেখিয়ে লাইন ভেঙে দ্রুত সার্ভিস আদায় করে নিতে চায় না, ব্যক্তিগত কাজগুলো অন্যকে দিয়ে করায় না, অফিসের অধস্তন কর্মচারীদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করায় না, দামী ঘড়ি, জুতো ইত্যাদি দেখিয়ে নিজের দাম বাড়াতে চায় না। এমন কী বয়সে বড়ো বলে ছোটোদের কাছ থেকে কেউ বাড়তি সম্মান আদায় করে নিতে চায় না। শুধুমাত্র সিনিয়রদের (যাদের বয়স ৬৫-র বেশি) তারা বাড়তি সম্মান করে, ছাড় দেয়, কারণ শারিরীক কারণে তারা নাজুক, ভঙ্গুর। কিন্তু সিনিয়রদের মধ্যে যারা শক্ত-সমর্থ তারা এই সুযোগ নিতে চায় না। প্রাচুর্যের ধনী লোকেরা তাদের আয়ের একটি বড়ো অংশ ব্যয় করে চ্যারিটিতে; এইসব চ্যারিটির তালিকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান খুব কমই দেখা যায়, মূলত তারা শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ক চ্যারিটিতেই অধিক দান করেন।
প্রাচুর্যের সংস্কৃতিতে দাপ্তরিক মিটিংয়ে খাবারের কোনো আয়োজন থাকে না। যদি মিটিংয়ের ভেতরে খাবারের সময় হয়ে যায় তখন খাবারের জন্য একটা ব্রেক দেওয়া হয় এবং প্রত্যেকে তার নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করে (কিনে বা বাসা থেকে আনা খাবার) খায়। কোনো আত্মীয়ের বাড়ি অল্প সময়ের জন্য বেড়াতে গেলে, যদি না সেটা খাবারের দাওয়াত থাকে, অতিথিকে খাওয়ানোর জন্য কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে না।
আচ্ছা এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত দিই। একবার বেলা এগারোটায় আমাদের পুত্রবধু ব্রিজিতকে আমাদের বাসা থেকে নিতে এলো ওর বোন মেগান। সেই নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্য থেকে গাড়ি চালিয়ে মেগান এসেছে। ব্রিজিত এসে বলে, আব্বু, আমি যাচ্ছি, মেগান আমাকে নিতে এসেছে। আমি তো অবাক। মেগান এসেছে আর তুমি চলে যাচ্ছ, এটা কেমন কথা। ওকে বাসায় আসতে বলো, এতো দূর থেকে মেয়েটা ড্রাইভ করে এসেছে কিছু একটা খাবে না? বাসায় উঠবে না, এটা কেমন কথা? আমার এইরকম আচরণে পুত্র অগ্নি এবং পুত্রবধু ব্রিজিত দুজনই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অগ্নি আমাকে বোঝায়, আব্বু, এখন তো কোনো খাওয়ার সময় না, তা ছাড়া ও-তো খাওয়ার দাওয়াতে আসেনি। ওদের সংস্কৃতিটা যে আমি বুঝি না তা-তো না, বরং আমাদের সংস্কৃতিটাও আমি ওদের একটু বোঝাতে চাইলাম।
এবার প্রাচুর্যের সংস্কৃতিতে ক্ষমতাবান মানুষেরা কেমন আচরণ করে তা বলি। আমি ইউরোপের অনেক মন্ত্রীকে দেখেছি সাইকেল চালিয়ে কিংবা পায়ে হেঁটে অফিসে আসেন। নিজের ডকুমেন্টটা নিজেই ফটোকপি করে নেন। একবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ডিনারে দাওয়াত করেন। তিনি অফিস
থেকে বাসায় ফিরে অতি দ্রুত কিচেন-এপ্রন পরে রান্না ঘরে ঢুকে যান। রান্না করতে করতে টেনশন করছিলেন অতিথি আসার আগে শেষ করতে পারবেন তো? তাকে সহযোগিতা করছিলেন তার স্বামী। ভাবুন তো দারিদ্রের সংস্কৃতিতে এই চিত্রটা কেমন হবে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ মার্চ ২০২৪