প্রথম দেখা
(শিরীনা ইয়াসমিন)
সরোজিনী বসে ভাবছে ওর বন্ধু আসবে কাল। বন্ধু বলা ঠিক হবে কী না সরোজিনী জানে না। তবে দু’একদিনের আলাপে তাকে বন্ধুই মনে হয়।যেন বহুকাল ধরে চেনে। সরোজিনী অনিন্দ্যর পরিচয় খুব কম সময়ের।তবুও ও বন্ধুকে আসার নিমন্ত্রণ করে। অনিন্দ্যরও আসার ভীষণ ইচ্ছে। এই অল্প দিনে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে।যেন ওরা যুগ যুগ ধরে চেনে একে অপরকে।
ঠিক হলো আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই আসবে।সরোজিনীর বন্ধু খুব কম।সবার সাথে ওর বন্ধুত্ব হয় না।অনেকেই ওকে অহংকারী হিসেবেই জানে।এতে অবশ্য ওর কিছু যায় আসে না।ও ওর মতো চলতেই পছন্দ করে।কে কী বললো এসবে ওর কোনো আগ্রহ নেই।
সরোজিনী শাড়ি পড়তে ভালোবাসে।বাংলা স্টাইলেই শাড়ি পরতে ভালোবাসে।তবে ও বাংলার সাথে একটা নিজস্ব স্টাইল যুক্ত করে নিয়েছে।কোমরে বিছা পরতে পছন্দ করে। বিছা বলতে যেটা বোঝায় ঠিক তেমন নয়।হালকা একটা চেনের মতো।সরোজিনী নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেনা।মাঝে মাঝে বিনা কারনেই সাজগোছ করে। আর উপলক্ষ হলে তো কথাই নেই।
বিকেল বেলা চা হাতে সরোজিনী বসে ভাবছে কোন শাড়ি পরবে। ও সব কালারই পড়ে,তবে ইদানীং বেইজ কালারটাই ওর বেশি পছন্দ। ও ভাবছে সাদা চিকন লালা পেড়ে একটা শাড়ি পরবে।এখানে শাড়ি পড়ে যাওয়া তেমন জরুরি নয়,তবু ও সময়টাকে ধরে রাখার জন্য অন্য একটা মাত্রা দেয়।ভালো লাগে ওর।
একটা সমস্যা মাথায় আসছে অনিন্দ্য আবার অন্য কিছু ভাববে নাতো!যা ভাবে ভাবুক ও শাড়ি পরবে।দু’হাতে রেশমি চুড়ি,কপালে একটা লাল টিপ, পায়ে আলতা পরতেও ইচ্ছে করছে,কেন করছে ও জানেনা।শাড়ির সাথে একটু উঁচু হিল পরলে ভালো লাগে কিন্তু ও একজোড়া স্লিপার পরবে।জুতো রেখে কিছুক্ষণ ঘাসে হাঁটবে।
এই প্রথম ওদের দেখা হবে।ওর ভিতরে কেমন একটা আলোড়ন হচ্ছে। সরোজিনী ভাবছে দুপুরে অনিন্দ্যকে কী খেতে দিবে।যেহেতু ঠিক করেছে নৌকা ভ্রমণে যাবে,তাই পরোটা মাংস নিবে।সরোজিনী খুব অতিথি পরায়ন।আরও অনেক কিছু খাওয়ানোর ইচ্ছে ছিল কিন্তু নৌকা ভ্রমণে এতোটা ঝামেলা করা যাবে না।
আজ শনিবার সরোজিনীর বন্ধু অনিন্দ্য আসবে।সকাল থেকেই ওর ছোটাছুটি আরম্ভ হলো। অনিন্দ্য যেহেতু বাসা চিনে না,ওকে বাস স্টপেজ থেকে রিসিভ করতে হবে।ন’টায় অনিন্দ্যর ফোন এলো বাসে উঠেছি।সরোজিনী সেজেগুজে রেডি হয়ে গেলো। চুলগুলো পিঠের পরে ছেড়ে দিয়ে কানে কানটানা সহ দুল পরেছে।ও নিজেকে আয়নায় দেখে মুগ্ধ হলো। বরাবরই ও নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়!সব সমস্যাকে পাশে রেখে ও বাঁচতে শিখে গেছে।আজ ওর খুব ফুরফুরে লাগছে।
এগারোটায় ফোন এলো,আমি এসেছি,তুমি যদি একটু আসতে;আমি তো কিছু চিনিনা এখানকার। সরোজিনী একটু দাঁড়াও প্লিজ, বলে একবারে বেরিয়ে পড়লো।হাতে খাবারের টিফিন ক্যারিয়ার,চায়ের ফ্লাস্ক, আরও একটা প্যাকেট।দেখতে যথেষ্ট অড লাগছে; কিছু করার নেই। একটা রিক্সা নিয়ে স্টপেজে পৌঁছে দেখে অনিন্দ্য বাস থেকে নামছে।
অনিন্দ্যর উচ্চতা অন্যদের থেকে ওকে আলাদা করে ফেলে। চুলগুলো হালকা কোঁকড়ানো, চোখে সানগ্লাস।ভিতরে একটা সাদা টি-শার্ট ওপরে একটা নীল রঙের ফরমাল শার্ট পড়েছে;হালকা শীত তাই হয়তো। একটা নীল জিন্স প্যান্ট পরেছে। সরোজিনীকে দেখে মিষ্টি করে একটা হাসি দিল। অনিন্দ্যকেও চিনতে সরোজিনীর এতোটুকু কষ্ট হয়নি কারণ দশজনের সাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওকে আলাদাই লাগে।যদিও ওকে আগে দেখেনি, শুধু ছবি দেখেছে।
সরোজিনী চায়ের ফ্লাস্ক নিতে ভোলেনি। অনিন্দ্য চা খেতে ভালোবাসে। অনিন্দ্য কাছে এসে বললো কী নিয়েছ এতোসব! কিচ্ছু না রিক্সায় ওঠ। রিক্সায় বসে অনিন্দ্য সরোজিনীর দিকে তাকিয়ে বললো এ কী! এতো সেজেছ কেন?তোমাকে দেখতে হবে না। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকো। সরোজিনী ওর দিকে তাকিয়ে দেখে ওর হাতে একটা সাদা ব্রেসলেট। ছেলেদের ব্রেসলেট পড়লে ওর ভালো লাগে।যদিও এটা অনেকের কাছে পছন্দ নয় সরোজিনীর ভীষণ ভাললাগে।
ওরা একটা রিক্সায় উঠলো,সরোজিনী বা পাশে বসেছে। অনিন্দ্যক জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবে?যেখানে নিয়ে যাবে।ওরা রিক্সা থেকে নেমে পড়ল, কিছু মানুষ ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছে;সরোজিনী অস্বস্তি ফিল করছে।ওরা একটা অটো নিলো, ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলো ঘাটে।
ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। অনিন্দ্য বলে উঠলো ওয়াও।এতো নৌকা একসাথে! সরোজিনী বললো এসব ধরো নৌকা ঠিক করবো।সরোজিনী যেন বহু বছর ধরে অনিন্দ্যকে চেনে, কোনো জড়তা নেই। নৌকা ঠিক করলো তিন ঘন্টার জন্যে। অনিন্দ্যকে ইশারায় ডাকলো সরোজিনী। সরোজিনী নৌকায় ওঠে হাত বাড়ালো।অনিন্দ্য হাত ধরে নৌকায় ওঠলো।
ওর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা হয়নি।তবে মনে হয় নৌকায় খুব বেশি চড়েনি।অনিন্দ্য স্বপ্ন বিলাসী,সরোজিনীর এ ক’দিনে তাই মনে হলো।ওরা দুজনে নৌকায় ওঠে বসলো যেনো ওরা বহুদিনের পরিচিত কোনো জড়তা নেই।সরোজিনী মাঝিকে বললো একটা কাজ করে দিলে ভালো হয়।টুকটাক কিছু লাগবে আপনি একটু নিয়ে আসুন।অনিন্দ্য বললো আমি আনছি,কী লাগবে বলো?তোমাকে যেতে হবে না।মাঝি ভাই নেমে গেলেন।
অনিন্দ্য সরোজিনীকে একদৃষ্টে দেখছে।সরোজিনী বললো কী এতো দেখছ!তুমি অন্যদের থেকে একদম আলাদা। তোমার দিকে তাকালে কেমন কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছিনা।আহা! এমন ভারী ভারী কথা রাখো তো, চা দিচ্ছি চা নাও।এতোক্ষণে ভিতরে ভিতরে চায়ের তৃষ্ণায় মরিয়া হয়ে ওঠেছ নিশ্চিত ।তুমি ঠিক কেমন করে বুঝে যাও আমি বুঝি না।
দুজনে চা খাচ্ছে এরই মধ্যে মাঝি এলেন,সরোজিনী দেখে নিলো সব ঠিক আছে কী না। সরোজিনী ওয়ান টাইম গ্লাস সংগে করে নিয়ে এসেছে,ও মাঝি ভাইকে চা দিলো।ওনি নিতে চাননি;সরোজিনী বললো খাননা আমাদের সাথে।চা খেয়ে নৌকা ছেড়ে দিলো মাঝি,হালকা শীত শীত অনুভূত হচ্ছে; ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ আরও শীত পড়ার কথা।ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হাওয়া নৌকা এগুচ্ছে ঠান্ডা বাড়ছে।সরোজিনী জানে বাসায় শীত না লাগলেও নৌকাতে শীত লাগবে।
সরোজিনী একটা প্যাকেট বের করলো।কী আছে ওটাতে! এতোকিছু কেমন করে আনলে।প্যাকেট থেকে দুটো কাশ্মীরী শাল বের করলো।ছেলেদের শালে তেমন বৈচিত্র্য নেই,সেই আগের মতোই আছ;তাও খুঁজে খুঁজে ভিন্ন রকমের একটা শাল কিনেছে।শালটা অনিন্দ্যর গায়ে জড়িয়ে দিল,কী করছ! কোনো কথা নয়,আরাম বোধ করবে, বলে নিজেও নতুন শালটা জড়িয়ে নিলো গায়ে।দাঁড়াও –দাঁড়াও — হাতটা দাও বলে সরোজিনী নিজে হাতে অনিন্দ্যর হাতে ব্রেসলেট পড়িয়ে দিলো।অনিন্দ্য সরোজিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
এখন বেশ আরাম পাচ্ছ না বলো!অনিন্দ্য অপলক দেখছে এরকম হয় কখনো!কী এতো দেখছ বলোতো!এবার বলো তোমার নৌকা ভ্রমণ কেমন লাগছে?দূরে তাকিয়ে দেখ গ্রাম গুলো কী ভীষণ রকম সুন্দর ।আমি আশা করছি তোমার ভালো লাগছে।প্রকৃতি দেখবো কী! আমি তো তোমাকে দেখেই কুল পাচ্ছি না।এতো কিছু তুমি কেমন করে করলে?
সরোজিনীর আতিথেয়তায় মুগ্ধ অনিন্দ্য!। একজন নতুন বন্ধুর জন্য এতো কিছু করে।ও মনে মনে আমাকে পছন্দ করে নাতো!সেরকম কোনো লক্ষ্যনই সরোজিনীর মধ্যে নেই।কেমন সাবলীল, আমি কেন যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।
ঠিক দুপুর, হিমেল হাওয়া তার মধ্যে সরোজিনী হাই তুলছে।অনিন্দ্য ভাবছে ও নিশ্চয়ই রাতে ঘুমোয়নি।অনিন্দ্য বললো তোমার ঘুম পাচ্ছে, চা দিবো?এখন চা খাবো কী! দুপুর হয়ে এলো, খাবে না?অনিন্দ্য বললো সবেতো একটা বাজে,এতো তাড়াতাড়ি খেয়ে অভ্যেস নেই।
ঠিক আছে চলো তাহলে চা খাই।সরোজিনী বললো আমি দিচ্ছি দাঁড়াও।অনিন্দ্য বললো এবার আমি দিচ্ছি তুমি বস।আজকের ভ্রমণ নিয়ে নিশ্চয়ই খুব অধীর ছিলে,রাতে ঘুম হয়নি, তা ছিলাম।
সরোজিনীর বসার ভঙ্গি সবার থেকে আলাদা।অনিন্দ্য ওর দিকে তাকিয়ে দেখে ও অন্যমনস্ক।কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে।অনিন্দ্য কিছু না বলে চুপ করে রইলো।নৌকায় বসেই প্রকৃতির ছবি তুলছে।
সরোজিনী সমীরের কথা ভাবছে।এই জীবনে আর কোনোদিন সমীরের সংগে দেখা হবে কী না সরোজিনী জানে না। অনিন্দ্য বলে উঠলো সরোজিনী দেখো কত পাখি,চমকে উঠলো সরোজিনী। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো আসছি; বলে গয়নার ছয়ের নীচ থেকে বেড়িয়ে এলো।অনিন্দ্য তাকিয়ে চমকে গেলো।ওকে শরৎচন্দ্রের দেবদাস ছবির পার্বতীর মতো লাগছে।উদাসীন, কী যেনো নেই,দুচোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
সরোজিনী কাউকে ভালোবাসে কী না জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনও। ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বললো তোমার ছবি তুলে দিই।সরোজিনী বললো চলো সেলফি তুলি।সে তোলা যাবে।আগে আমার বন্ধুর কয়েকটা ছবি তুলে দিই। দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেলো। কেমন করে সময় কেটে গেলো ওরা টেরই পেলো না।অনিন্দ্যকে ফিরতে হবে।সরোজিনী নৌকা ঘুরাতে বললো।
ফিরতে ফিরতে ওকে আশেপাশের গ্রামের নাম গুলো বললো।প্রত্যেকটা গ্রামই ছবির মতো সুন্দর। অনিন্দ্যর জায়গাটা খুব ভালো লেগে যায়।অনিন্দ্য বললো তুমি বললে আবার আসবো একদিন।কেন নয়! অবশ্যই আসবে।অনিন্দ্য সরোজিনীকে কোলে করে নামালো।সরোজিনী কিছু বুঝে উঠার আগেই। কী করছ,কী করছ!আমার জন্য এতো কষ্ট করেছ, আমার পক্ষ থেকে ভলোবাসা।
ওরা একটা সি এন জি নিলো।দুজন কাছাকাছিই বসেছে।সরোজিনী এতোটা নিঃসঙ্গ ওর একটা কাঁধ দরকার যেখানে ও মাথা রাখতে পারে।অনিন্দ্য বুঝতে পেরে বললো কাছে এসো,সরোজিনী বললো ঠিক আছি।খুব ঠান্ডা লাগছে,সরোজিনীর শীত বেশি,ও কাঁপছে। অনিন্দ্য ওকে কাছে টেনে শালে জড়িয়ে নিল।সরোজিনী কোন বাঁধা দিল না।প্রায় ঘন্টা খানেক ওরা একে অপরকে জড়িয়ে রইলো। অনিন্দ্য ওকে কপালে,ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেল।সরোজিনী অনিন্দ্যর বুকে মাথা গুঁজে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।সরোজিনীর মনে হলো যদি আমৃত্যু এভাবে থাকা যেত।অনিন্দ্য আস্তে করে মাথাটা তুলে ধরে বললো ভালো থেকো।আমি আবার আসবো।সরোজিনী আবারও জড়িয়ে ধরলো।
সি এন জি থেকে নেমে একটা অটো রিক্সায় বাস স্টপেজ এলো।বহু সময় বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে রইলো।একটাও বাস নেই,চলো সামনে গেলে অনেক বাস পাওয়া যাবে ওখানে যেয়ে বাসে তুলে দিই বললো সরোজিনী।অনিন্দ্য প্রথমে না করেছে কিন্তু গেলে যে খুশি হবে সরোজিনী বুঝতে পেরেছে।ওকে নামিয়ে দিয়ে আসার সময় অনিন্দ্য অনেকক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে।সরোজিনী হাত নেড়ে বাই জানালো,অনিন্দ্যও।
অনিন্দ্য সরোজিনীর উদাস চোখে নিজেকে ফেলে গেলো।সরোজিনী বাঁধা পড়লো অনিন্দ্যর শূন্য বুকে।