কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি:
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (৩০ সেপ্টেম্বর, ১২০৭–১৭ ডিসেম্বর, ১২৭৩) অথবা পরিচিত আছেন জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ বালখী, মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি নামে তবে শুধু মাত্র রুমি নামে বেশি জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন ১৩ শতকের একজন ফার্সি-সুন্নি মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী এবং সুফী।
তাঁর কবিতা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন শ্রেণীতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের “সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি” এবং “বেস্ট সেলিং পয়েট” বলা হয়। রুমির সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও তিনি অনেক স্তবক তুর্কি, আরবি এবং গ্রীক ভাষায়ও রচনা করেছেন। তাঁর লেখা “মসনবী” কে ফার্সি ভাষায় লেখা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসাবে তুলনা করা হয়।
ইরান সাম্রাজ্য এবং বিশ্বের ফার্সি ভাষার লোকেরা এখনও তাঁর লেখাগুলো মূল ভাষায় ব্যাপকভাবে পড়ে থাকে। অনুবাদসমূহও খুব জনপ্রিয়, বিশেষ করে তুরস্ক, আজারবাইজান, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ এশিয়ায়।
তাঁর কবিতা ফার্সি সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। শুধু তাই নয় তুর্কি সাহিত্য, উসমানীয় তুর্কি সাহিত্য, আজারবাইজান সাহিত্য, পাঞ্জাবের কবিতা, হিন্দী সাহিত্য, উর্দু সাহিত্যকেও অনেক প্রভাবিত করেছে।
এছাড়াও অন্যান্য ভাষার সাহিত্য যেমন তুর্কীয়, ইরানী, ইন্দো-আর্য, চাগাতাই, পাশতো এবং বাংলা সাহিত্য ও বাংলাকে প্রভাবিত করেছে।
রুমি জন্মগ্রহণ করেন স্থানীয় ফার্সি ভাষী মাতাপিতার কাছে, যারা মুলত বালখ্ এর বাসিন্দা যা বর্তমানে আফগানিস্থান। তিনি হয় ওয়ালখ্স যা বৃহৎ বালখ্ সম্রাজ্যের বালখ্স নদীর কাছে একটি গ্রাম যেটি বর্তমানে তাজাকিস্তান, অথবা তিনি বালখ্ শহরে বর্তমান আফগানিস্থান এ জন্মগ্রহণ করেন।
রুমি এর শিক্ষার সাধারণ বিষয়বস্তু ছিল অন্যান্য ফার্সি সাহিত্যের মরমী এবং সুফী কবিদের মত তাওহিদ শিক্ষা। তাঁর সাধনা অর্জনের ইচ্ছা এবং আকাঙ্কা প্রতিয়মান হয়ে উঠে তাঁর বই মসনবী এর নিম্নোক্ত কবিতায়:
আমি পাথর হয়ে মরি আবার গাছ হয়ে জন্মাই গাছ হয়ে মরি আবার পশু হয়ে জাগি, পশু হয়ে মরি আবার মানুষ হয়ে জন্মাই তাহলে ভয় কীসের? কীবা হারাবার আছে মৃত্যুতে? পরবর্তি পদক্ষপে আমি মানুষের প্রকৃতিতে মারা যাব, যাতে স্বর্গদূতদের সাথে আমার মাথা এবং ডানা উঁচু করতে পারি, এবং অবশ্যই স্বর্গদূতদের নদী থেকে লাফ দিব, সবকিছুই নশ্বর শুধুমাত্র তিনি(সৃষ্টিকর্তা) ছাড়া, আবারও আমি স্বর্গদূতদের মধ্য থেকে উৎসৃষ্ট হব, আমি কি হব তা আমার কল্পনার বাইরে, তারপর আমি অস্তিত্বহীন হব; অস্তিত্বহীন আমকে বলে(সুরের মাধ্যমে) বাঁশির ন্যায়, প্রকৃতপক্ষে, তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। রুমির কাব্যকে মাঝেমধ্যে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়: চতুষ্পদী শ্লোক এবং গজল। গদ্যসমূহকে ভাগ করা হয় প্রবন্ধ, পত্র, এবং “সাতটি ধর্মাপদেশ” এ।
১। রুমির প্রধান কাজ হচ্ছে “মাতনাওয়ে মানাউয়ি”(আধ্যাত্মিক দ্বিপদী; مثنوی معنوی), একটি ছয় খন্ডের কবিতা কয়েকজন সূফী এটিকে বিবেচনা করেন ফার্সি ভাষার কুরআন হিসাবে। অনেকে একে তুলনা করেন যে সেরা অতীন্দ্রি়বাদী কবিতার কাজগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে। এতে প্রায় ২৭,০০০ লাইনের ফার্সী কবিতা রয়েছে।
২। রুমির আরেকটি প্রধান কাজ হচ্ছে “দেওয়ান-এ-কবির”(“প্রধান কাজ”) বা “দেওয়ান-এ শামস তাবরিজী”(শামস তাবরিজী এর কাজ); دیوان شمس تبریزی), যেটি নামকরণ করা হয় রুমির শিক্ষক শামস তাবরিজীর নামে। এছাড়া এতে ৩৫০০০ ফার্সী দ্বিপদী এবং ২০০০ ফার্সী শ্লোক আছে, এতে ৯০টি গজল এবং ১৯টি শ্লোক আছে আরবি ভাষায়, এছাড়া প্রায় চব্বিশটি দ্বিপদী তুর্কি ভাষায় এবং ১৪টি দ্বিপদী গ্রীক ভাষায়।
এটা অনস্বীকার্য যে রুমি ছিলেন একজন মুসলিম পণ্ডিত এবং ইসলামকে তিনি গম্ভীরভাবে নিয়েছেন। তবুও, তার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা সম্প্রসারিত হয়েছে সীমিত সাম্প্রদায়িক সংস্পর্শে। তার একটি কবিতায়:
অন্বেষণকারীদের পথে জ্ঞানী- মূর্খ সব একই। তাঁর ভালোবাসায় পরিচিত-অপরিচিত সব একই। এগিয়ে যাও! ভালোবাসার অমৃত সুধা পান করো। সে বিশ্বাসে, মুসলিম-পৌত্তলিক সব একই।
রুমির অনেক কবিতায় সুপারিশ করে বাহ্যিক ধর্মীয় রীতি এবং কুরআনের প্রধান স্থানের গুরুত্বকে।
আল্লাহর কোরআনের কাছে যাও, তাতে আশ্রয় নাও সেখানে নবীর আত্নার সাথে মিশ বইটি বহন করে নবীর বিভিন্ন অবস্থার কথা সমুদ্রের ন্যায় তাঁর পবিত্র মহিমা প্রকাশ কর। মাওলানা রুমি পর্যালোচনা
“মাওলানা রুমি রিভিউ” (আইএসএসএন ২০৪২-৩৩৫৭) বার্ষিকভাবে প্রকাশিত হয় এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি এবং ইরানি চর্চা কেন্দ্র থেকে সাইপ্রাসের নিকোশিয়ার রুমি ইনস্টিটিউট এবং ক্যামব্রিজের আর্কেটাইপ বুকস এর সহযোগিতায়।
প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে এবং এরপর থেকে প্রতি বছর এটি প্রকাশ করা হয়। সাময়িকীটির প্রধান সম্পাদক লিউনার্দ লিওশিন এর মতে: “গুরুত্ব এবং ফলাফল এ দান্তে, শেকসপিয়র এবং মিল্টন এর যদিও কয়েকজন মুসলিম কবি সহজ প্রতিদ্ধন্ধী, পশ্চিমে তারা সাহিত্য খ্যাতি উপভোগ করে কারণ আরবি এবং ফার্সি দার্শনিক, লেখক এবং কবিদের নগণ্য, তুচ্ছ এবং রুচিহীন হিসাবে দেখে ওয়েস্টার্ন ক্যাননের মহা আখ্যানের কাছে। মাওলানা রুমি রিভিউ এর লক্ষ হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যে এসব তাচ্ছিল্যপূর্ণতার অবসান ঘটানো, যেটি পশ্চিমা সাহিত্যের ভুল কল্পনার চেয়েও আরও গভীর।”