কাজল কালো চোখ
পারভীন আকতার
কেয়া কি করছো?
একটু এদিকে আসতে পারবে?
খুব দরকার না হলে ডাকতাম না। এদিকে এসো একবার প্লীজ।
নিখিল মাস্তুল হাতে দাঁড়িয়ে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।তবুও কেয়ার আসার নাম গন্ধ নেই।
আসলে কেয়া অলস দুপুরে নাকে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। বড্ড আরামের ঘুম।এই শীতের সেরা সময় দুপুরঘুম।হালকা রোদ মিষ্টি আলোয় ঘুমে স্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে।
এই উঠো!নিখিল নাকের ডগা থেকে কম্বল তুলে এক পাশে ফেলে রেখে হাত ধরে টানতে টানতে কেয়াকে নীচে নামালো।
কী করছো? আমি ঘুমাব আরো কিছুক্ষণ। ছাড়ো। কেয়া আবার আরেকটা লেপ নিয়ে ঘুম!
বাপরে! নিখিল অকৃতকার্য হলো।
দাঁড়াও আসছি বলে নিখিল এক জগ পানি এনে কেয়ার গায়ে ঢেলে দিল।ব্যস,পুরো বিছানা ভিজে শেষ। এমন ঠান্ডায় গায়ে পানি! আৎকে উঠে কেয়া টাস করে নিখিলের গালে দিলো লাগিয়ে থাপ্পড়।
উফ,ব্যথা পেলাম।নিখিল গালে হাত ধরে আছে। এদিকে সুনয়না সব বাইরের জানালা দিয়ে দেখছে। আর হাসছে।পাজি দুইজন। সারাক্ষণই লেগে থাকে।পারেও বটে।
এই কী হয়েছে তোমার,আমাকে পানি দিয়ে তোলার মতো কী হলো? কেয়া রেগে ফায়ার।
বাহ্ রে! তুমিই না বললে ওয়াশরুমের শিটকিনি ঠিক করে দিতে। আমি কি জানি তুমি কোথায় কাল বাক্সটা রেখেছো?ঘুমানোর আগে সামনের রুমে রাখতে পারতে। আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।দুই ঘন্টার ছুটি নিয়ে এলাম। আর তুমি আরামে ঘুমাচ্ছো। নিখিল মাস্তুল দিয়ে টস করে কেয়ার গায়ে আলতো দিল বাড়ি।
ওহ,সরি।ভুলেই গিয়েছিলাম।আজ আমি দরজার কারণে ওয়াসরুমেও যেতে পারিনি।
সুনয়না কেবল তাকিয়ে থাকে।আমাদের কষ্ট দেখে সে হাসে না উপহাস করে বুঝি না।
কেয়া চুলে খোঁপা বেঁধে ভিতরের রুম থেকে বাক্স আনতে গেল।
সুনয়না এসে নিখিলের দিকে ভ্রু কুঁচকে বলা শুরু করল, এভাবে আর কতো দিন, ঘরে দু’টো মেয়ে।অন্যদের কথা বাদই দিলাম। আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।আজ এখানে এসেছি এক মাস। তোমার সময় হয় না ছোটখাটো কাজগুলো করে দিতে।সুনয়না নিখিলকে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে চলে গেল।
এই নাও,নিখিলের মন খারাপ।ভালই বলেছে। উচিৎ হয়েছে।এতোদিন পর হলেও তার মুখ খুলেছে। কেয়া ঢং ঢং করে বেরিয়ে গেলো ভেজা লেপ শুকাতে দিতে।
হায়রে কপাল!সুনয়না এভাবে আজীবন আমাকে ভুল বুঝে গেলো।আমার যে চাকরী আমি একটি মিনিট সময় পাই না, ওরা এসব বলে কী! আজ দুইজনকে বসিয়ে তবেই এসেছি।
যাক,কপাল সব!
এই যে ঠিক হয়েছে দেখে আসেন ম্যাম।সুনয়না পিছন থেকে পুরো কারুকাজ দেখেছে এতোক্ষণ। ভালো করেছেন।এবার খাওয়া দাওয়া করে বিদায় হউন।সুনয়না ক্ষ্যাপা আচরণ দেখে নিখিল চুপচাপ খেয়ে অফিসে চলে গেল।রাগালে তার আরো দেরী হতো। যাক আজকের মতো ঝগড়া খতম।
কেয়া আর সুনয়না মামাতো ফুফাতো বোন। নিখিল তাদের একমাত্র নানা বাড়ীর দূর্সম্পকের জ্ঞাতি ভাই।সবাই মিলে এক সাথে শহরে একটা কম দামী ভাড়া বাসায় থাকছে। যে যার মতো থাকে তবে এক সাথে রান্না বান্না চলে।এই খাওয়ার ঝামেলার কারণে দুই নারীর অগ্নিরূপ সহ্য করেই থাকছে নিখিল।আহা! একেবারে পুরুষ নির্যাতন যাকে বলে।
দিন যতই এগিয়ে যায় নিখিল সুনয়নার দিকে প্রেমের পরশ বুলাতে চায়। এই যে এত কষ্ট করে আছে কোন রকম; তা আর মাথায় নেই তার।সুনয়নাকে দেখলেই তার হাত থেকে জিনিস পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি করে।একদমই আনমনা।কী করবে নিখিল ভাবে কেবল।কীভাবে সেই কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে,আমি তোমায় ভালোবাসি সুনয়না। বাপরে! সে যেমন বদমেজাজি; নিখিল ভয়ে চুপসে যায়।হয়তো একদিন সাহস করে বলেই ফেলবে, নয়তো একগুছা রজনীগন্ধা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভালোবাসা, ভালোলাগার কথা বলেই ফেলবে।
এই নিখিল কোথায় গেলে, সুনয়না কন্ঠ শুনতেই নিখিল বেচারা হাজির।
কী হয়েছে সুনয়না, এত হাঁকডাক কেন? নিখিল উপরে বেশ বিরক্তির ভান ধরল।
ওমা, সেকী কথা! তোমার চিঠি এসেছে। এই মাত্র পিয়ন দিয়ে গেল।
কয় দেখি, দেখি।খাম খুলতেই চোখে জল চলে এলো নিখিলের।না, কষ্টের নয়। এ সুখের, আনন্দের জল। একটি পরিবারের মুখের হাসি ফুটানোর ব্যবস্থা। বর্তমানের কষ্টের কম বেতনের চাকরীটা থেকে মুক্তি মিলল।
কী আছে এতে পড়ে শোনাও দেখি। সুনয়না পড়তে বলেই তার হাতে খামটা নিয়ে নিল।
খুশিতে সুনয়না নিখিলকে জড়িয়ে ধরলো।
নিখিল বরফের মতো জমে গেল মনে হলো।
সুনয়না এতো ভালোবাসে আমায়! কয় কখনো তো খেয়ালই করিনি!
ছাড়ো এবার কেউ দেখে ফেলবে। নিখিল যদিও ছাড়তে চায় না তবুও লৌকিকতা ম্যানটেইন করা লাগে।
তো কী ভাবছো,ব্যাংকে চাকরী হলো।আমাদের ছেড়ে চলে যাবে এই তো?সুনয়না খুব কষ্ট পাচ্ছে নিখিল অনুভব করছে।
না,যাব না।যদি তুমি চাও আজীবন তোমার কাছেই কাটিয়ে দেবো। নিখিল মাথা নীচু করে কী যেন ভাবে।
আমিও কি তোমাকে হারাতে চাই বল?আমার সব বই তোমাকে এমনি পড়তে দিয়েছি নাকি? আমার স্বার্থে দিয়েছি। আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।নিখিলের হাতদুটো শক্ত করে ধরলো সুনয়না।
কোনদিক না তাকিয়ে,লোকারন্য পেরিয়ে সেই দুই হাত, চার হাতে মিলেছে। পায়ে পা মিলিয়ে খুব কাছের নয়নাভিরাম প্রেমের স্বর্গে প্রবেশ করেছে দুজনে। নিখিল মরেছে সুনয়নার কাজল কালো চোখের প্রতিবিম্বে। সেই অদ্ভুত এক অনুভূতি!
লেখক: কবি ও শিক্ষক, চট্টগ্রাম।
১ Comment
nice story