পান্তা বুড়ী।
জসীম উদ্দীন।
পান্তা বুড়ী রোজ পাতিল ভরে ভাত রাঁধে। তার কতকটা খায়, আর কতকটায় পানি ঢেলে পান্তা করে রাখে। পানির ঠাণ্ডায় ভাত পচে যায় না। রোজ সকালে উঠে সে সেই পান্তা ভাত খায়। এক চোর টের পেয়ে রাত্রে বুড়ী ঘুমাইলে ঘরে ঢুকে তার পান্তা খেয়ে যায়। বুড়ী সকালে উঠে সোরগোল করে। চোরের চৌদ্দ পুরুষ ধরে গালিগালাজ করে। শুনে চোর মনে মনে হাসে। রাতের বেলা বুড়ী ঘুমাইলেই সে আবার ঘরে ঢুকে আগের মতোই তার পান্তা ভাত খেয়ে যায়। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়।
বুড়ী সকালে উঠে রাজার বাড়ি চলল নালিশ করতে।
যেতে যেতে বুড়ী দেখতে পেল পথের উপর একটি শিং মাছ নড়ছে। সে বুড়ীকে দেখে বলল, “বুড়ীমা, আমাকে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে যাও। এখানে থাকলে আমি মরে যাব।”
বুড়ীর মনে বড়ই দয়া হল। সে মাছটি উঠিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিল।
তারপর হনহন্ করে সে পথে যেতে লাগল। খানিক গিয়ে দেখতে পেল পথের মধ্যে একটি ছুরি পড়ে আছে। ছুরিখানা বুড়ীকে বলল, “বুড়ীমা, এই পথ দিয়ে কত লোক যাবে, অসাবধানে কেহ আমার উপর পা ফেললে পা কেটে যাবে। আমাকে ওই কাঁটা গাছের ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে যাও না।”
বুড়ী ছুরিখানা হাতে নিয়ে কাঁটাগাছের ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল। আরও খানিক যেতে বুড়ী দেখতে পেল একটি গাই লতাপাতায় জড়িয়ে আটকে গেছে। গাইটি বলল, “বুড়ীমা, আমি লতাপাতার মধ্যে জড়িয়ে আছি। আমাকে একটু ছাড়িয়ে দাও না।” শুনে বুড়ীর দয়া হল; সে দুই হাতে লতাপাতা ছিঁড়ে দিল। গাইটি খুশী হয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘাস খেতে লাগল।
আরও খানিক যেতে পথের ধারের একটি বেলগাছ বুড়ীকে ডেকে বলল, “বুড়ীমা, একটু শুনে যাও।”
বুড়ী থেমে বলল, “কি বলবে বাছা! তাড়াতাড়ি বল। আমি রাজার বাড়ি যাব। রাজসভা ভাঙ্গল বলে। তাড়াতাড়ি বল কি বলবে।”
বেলগাছ বলল, আমার চারিধারে এত আগাছা জন্মিয়াছে যে, আমি ভালো করে দম্ নিতে পারতেছি না। আর মাটির ভিতরে যা কিছু রস আছে, আগাছা গুলো খেয়ে ফেলে। আমার জন্য কিছু থাকে না। দিনে দিনে আমি শুকিয়ে যাচ্ছি।”
শুনে বুড়ীর দয়া হল। সে বহু কষ্টে বেলগাছের চারিধারের আগাছাগুলি টেনে উপড়ে ফেলল। বেলগাছ ভালো করে নিঃশ্বাস নিয়ে বুড়ীর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগল।
সেখান হতে বুড়ী আরও তাড়াতাড়ি পথ চলতে লাগল।
রাজসভা তখন ভাঙ্গে ভাঙ্গে অবস্থা। বুড়ী এগিয়ে গিয়ে বলল, “এক চোর রাত্রে এসে রোজ আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়, তুমি এর বিচার কর।”
রাজা বলল, “তুমি যদি চোর ধরে আনতে পার, আমি তার বিচার করতে পারি। কে তোমার পান্তাভাত খেয়েছে না জেনে কার উপর বিচার করব?”
রেগে গিয়ে বুড়ী বলল, “তবে তুমি কেমন রাজা হে? চোর ধরতে পার না? তোমার আশীগণ্ডা পাহারাদার কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে রাতে ঘুমায়? তারা থাকতে আমার বাড়িতে কেমন করে চোর ঢোঁকে?”
রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট বুকে নিয়ে বুড়ী বাড়ির দিকে চলল। ফেরার পথে বেলগাছের কাছে আসলে, বেলগাছ জিজ্ঞাসা করল, “বুড়ী মা! বড় যে বেজার হয়ে ফিরে চলেছ, খবর কি?”
বুড়ী উত্তর করল, “এক চোর এসে রোজ আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়। রাজার কাছে গিয়াছিলাম বিচার চাইতে। রাজা বিচার করল না।”
বেলগাছ বলল, “আমার একটি বেল নিয়ে যাও, রাত্রে চুলার মধ্যে পোড়া দিয়ে রেখো।” একটি বেল ঝোলার মধ্যে ভরে হনহন করে বুড়ী পথ চলতে লাগল।
খানিক যেতে গাই এর সাথে দেখা। গাই জিজ্ঞাসা করল, “বুড়ীমা, বড় যে বেজার হয়ে চলেছ!”
বুড়ী বলল, “এক চোর আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়। রাজার কাছে এর বিচার চেয়েছিলাম। রাজা বিচার করল না।”
গাই বলল, “আমার একনাদা গোবর নিয়ে যাও। আজ তোমার দরজার সামনে রেখে দিও।”
কলাপাতায় করে একনাদা গোবর নিয়ে বুড়ী আবার পথ চলতে লাগল।
খানিক যেতে ঝোপের ভিতর হতে ছুরি জিজ্ঞাসা করল, “বুড়ীমা, তোমার মুখখানি যে বড় বেজার বেজার?”
বুড়ী বলল, “এক চোর এসে রোজ রাতে আমার পান্তাভাত খেয়ে যায়। রাজার কাছে গিয়াছিলাম বিচার চাইতে। রাজা বিচার করল না।”
ছুরি বলল, “বুড়ীমা! এক কাজ কর, আমাকে নিয়ে যাও। তোমার হাতের গোবর এর গাদার মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রেখো।”
বুড়ী ছুরিখানা ঝোলার মধ্যে নিয়ে আবার পথ চলতে লাগল। আরও খানিক যেতে পুকুরের ভিতর হতে শিংমাছ ডেকে বলল, “বুড়ীমা! মুখখানা যে বেজার বেজার লাগছে?”
বুড়ী তাঁকে সব কিছু খুলে বলল।।
মাছ বলল, “বুড়ীমা! আমাকে নিয়ে যাও। আমাকে তোমার পান্তাভাতের হাঁড়িতে রেখে দিও।”
বুড়ী শিং মাছটি তার ঝোলার মধ্যে ভরে নিল। দুপুরের বেলা তখন গড়িয়ে পড়েছে। এত পথ চলে ক্ষুধায় বুড়ীর পেটে আগুন জ্বলতেছে। সে আরও জোরে জোরে পথ চলতে লাগল।
বাড়ি এসে বুড়ী এক পাতিল ভাত রেঁধে কতক খেল আর কতক সেই হাঁড়ির মধ্যে রেখে পানি ঢেলে পান্তাভাত করল। পানি সমেত সেই পান্তাভাতের মধ্যে শিং মাছটিকে ছেড়ে দিল। তারপর দরজার সামনে গোবর নাদা রেখে তার ভিতরে ছুরিখানা লুকিয়ে রাখল। বেলটি চুলার মধ্যে পোড়া দিয়ে কাঁথা-কাপড় মুড়ি দিয়ে বুড়ী নাক ডেকে ঘুমাতে লাগল।
এদিকে রাত্রে চোর এসে যেই পান্তাভাতের হাঁড়িতে হাত দিয়েছে, অমনি শিং মাছ তার হাতে কাঁটা ফুটিয়ে দেয়। ব্যথার জ্বালায় চোর লাফ দিয়ে পালাতে যায়। তখন গোবর নাদায় পা পিছলে পড়ে। গোবর নাদায় পড়ে যেতেই ছুরিতে লেগে পা কেটে গেল! পায়ের আঘাতে গোবর ছিটে চোখে মুখে এসে লাগল। চোর সামনে পুকুরে হাত পা ধুয়ে ভাবল, বুড়ীর আখার উপর গিয়ে হাত-পা গরম করে নেই।
যেই সে আখার উপর হাত পা গরম করতে গিয়েছে, অমনি আগুনে পুড়ে বেলটি ফেটে চোরের চোখে-মুখে লেগে ফোস্কা করে দিয়েছে।
বেল ফাটার শব্দ পেয়ে বুড়ী “কে রে! কে রে!” করে জেগে উঠল। চোর তখন দে দৌড়। সেই হতে চোর আর বুড়ীর ত্রিসীমানায় আসে না। মজা করে বুড়ী পান্তাভাত খায় আর সারাদিন বসে ছেঁড়া কাঁথায় জোড়াতালি দেয়।