পাগল নাকি
এটিএম ফারুক আহমেদ
তারিখ: ১২.০৩.২০২৩ইং
সুলতানা মিহিকে মিষ্টি সুরে কাছে ডেকে পাশে বসায় মাসুম।
মিহি সুলতানা মিহি– এদিকে আস… কথা আছে… এরূপ মিহি ডাক আগেও মাসুমের কন্ঠে সে শুনেছে এবং যখনই অমন মহন্ত ডাক শুনে কাছে গেছে, তখনই দেখা গেছে একটা অনাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে কি দিয়েছেই মাসুম। এটা একটা ভীতিকর ডাক, তবুও পাকঘর ছেড়ে সে গিয়ে মাসুমের পাশেই বসে। আজ যদি একটা মিষ্টি ভাষণ দেয় মাসুম!
মাসুম কিছু বলার আগেই সুলতানা বলে- ঐ তো বুঝেছি কেন এতো সোহাগের সুরে ডাকলে? সুলতানার মুখে বিরক্তির ছাপ লক্ষ্য করে মাসুম, তবুও মাসুম সংযত রাখে নিজকে। কি বলতে চাইলাম, আর ও কিনা এমন ঝাঁঝালো কথা বললো! আশ্চর্য? মনে মনে মাসুমের স্বগোতক্তি।
নিজেকে সামলে মাসুম সুলতানাকে বলে দেখ- মাইন্ড করো না প্লিজ। আমি তো সংসার ভাঙার কথা কখনো বলিনি! তুমি ক্লাসমেট, প্রেম করে বিয়ে করি ভাঙার জন্যে? সেই ইউনিভার্সিটি লাইফের কথা মনে কর তো! কি সুন্দর, স্বচ্ছ দিনগুলো ছিলো? তুমি রোকেয়া হলে, আমি সূর্য সেনে! কি মধুর, রোমাঞ্চকর লাইফ! বিকেলে তুমি হল গেইটে দাঁড়াতে, আর আমি সময় মত না পৌঁছালে তুমি ক্ষেপে যেতে? হলের বন্ধুরা টানতে একদিকে, আর আমি ছুটতাম তোমার পিছে? কি দারুণ সময় চলে গেলো জীবন থেকে, কি বলো ঠিক না?
মাসুমের এরূপ বক বক সুলতানা মিহির ভালো লাগেনা। সে বিরক্ত হতে হতে শোনে। ভাঙার কথা বলে! কি ভাঙবে? সংসার! মিহি মাসুমের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, চোখে জল! কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষে বলে ধ্যাৎ বকবকানি বাদ দিয়ে মতলবটা কি বলো? আরেকটা মাইয়া মানুষ লাগে তো! বুঝেছি, আমি তো আজ ১৪/১৫ বছরেও কোন বাচ্চা দিতে পারিনি, তাই না? তো যাও কর! তোমরা তো পুরুষ মানুষ ৪/৫টা বিয়ে করতে পার। তোমাদের অনুমোদন আছে। আমরা তো আর দুইটা পুরুষও রাখতে পারিনা! করো, করগে! তোমার রাস্তা পরিষ্কার।
আচ্ছা মিহি আমি তো তা বলিনি! আমি ইউনিভার্সিটি লাইফের দিনগুলোর কথা বলছিলাম–
মাসুম কথা শেষ করার আগেই মিহি সুলতানা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-, আরে রাখ, এখনো তুমি ঐ সখের কথাই বলতে! তোমাকে চিনি না! বাচ্চা হয় না তো আমার কি দোষ? চেষ্টা তো করি?
মাসুম- তুমি কথা অন্য দিকে নিচ্ছ কেন? আমি তো দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলিনি! তুমিই তো বলেছ এবং এখনো বলো!
মিহি সুলতানা- আমি এখনো বলি?
মাসুম- বলো না? বলো কি! তুমি তো এ-ই মাত্রও বললে, মাসুমের খেদোক্তি।
মিহি সুলতানার রাগ ধরে। সে বলে ওঠে – আমি তো তোমারে পেট ভাড়া নিতে বলেছি। যাও একটা পেট ভাড়া কর, আর পেট বাজাইয়া দাও, বাচ্চা হবে, আর ঐ বাচ্চা তোমার হবে। লুচ্চা কোথাকার! – বলেই মিহি হন হন করে চলে যায় ভেতরের কক্ষে। ধপাস করে দরজা লাগিয়ে ছিটকানি বন্ধ করে দেয়।
মাসুম একদৃষ্টে মিহির চলার পথে কটমটিয়ে চেয়ে থাকে। আর মনে মনে বলতে থাকে, শালা- এতটা বছর এতো চেষ্টা করলাম-! আমার তো কোন দোষই পায়নি ডাক্তার। ফার্টিলিটি সমস্যা তো আমার নয়! শালা ডাক্তার তো স্পষ্ট করে কিছু বলেওনা।তো কবে বাচ্চা হবে? মা বা, পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব সবাই প্রশ্ন করে- শালা তুমি করোটা কি? তোমার এতটা বছরেও বাচ্চা তো হলোইনা, ভাবী conceiveও করেনা? আশ্চর্য! তুই শালা আরেকটা কর! বাচ্চা হবে, আর বাচ্চার বাপও হবে। আর এই মিহিটাও কতোবার আরেক বিয়ে করতে বললো! আর এখন যেই রাজি হতে চলেছি, তখনই সে বোল পাল্টে ফেললো। আমি পেট ভাড়া নেবো, আমি লুচ্চা! আশ্চর্য? আমি না নামাজ রোজা করি! ওরে ছাড়া থাকতে পারিনা! আজ এতোটা বছর কেটে যায়, মনে হয় একদিন, এমনকি একরাতের জন্যেও ওর একা রেখে কোথাও থাকিনি। মিহি তো জান আমার। এতো ভালোবাসা গেলো কই? এ কি সুর খোদা! একটা সন্তান দিলে এমন ক্ষতি কি! হোক মেয়ে, হোক না ছেলে! একটা হলেই তো চলে? আমি সবার মুখ হতে রক্ষা পাই, আমার বউ আমার মিহি হাসিখুশিতে থাকে, আমিও থাকি! আচ্ছা খোদা-, তুমি চাওটা কি? তোমার তো অনেক আছে, অফুরন্ত! দাওনা একটা সন্তান। মিহি আমার জান, আমার থাকবে। সন্তান না হোক,ক্ষতি কি? কতো প্রশ্ন কুঁড়ে খায় মাসুমকে। নিজের অজ্ঞাতে চোখ বেয়ে অশ্রু টলটল করে ঝরে পড়ে।
কখন চুমকি এসে চা রেখে যায় টেবিলে মাসুম লক্ষ্য করেনি। সে তো মাথা নিচু করে চিন্তায় অন্য জগত সমুদ্রে এতোক্ষণ ডুবে ছিলো।
চুমকি এসে বললো- দুলাভাই আপা চা করে পাঠিয়েছে, কখন দিয়ে গেলাম! এখনো খাননি? আহ্ ঠান্ডা হয়ে গেলো যে! খান..! কাঁদবেননা দাদা। আপা আপনাকে বিষম ভালোবাসে। ভাবনা কিসের? ছেলে সন্তান একসময় হবেই। চালচুলো যখন আছে, রান্না হবেই। বিয়ার দরকার কি? বিয়া তো করছেনই!
মাসুম চোখ মুছতে মুছতে চায়ের কাপ হাতে নেবে। অমনি ম্যাসেজ অপশনে তখুনি আসা ম্যাসেজের প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে। চা হাতে নিতে নিতে এক নজর চুমকিকে দেখে এবং জিজ্ঞেস করে- তোর আপা কই? পাক ঘরে গেলো কখন! আবার চাও পাঠালো? আসলে তোর আপাটা খুউব ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে। তবে মুখে বিষ বেশি। আমারে সব দেয়, তবে ভুগিয়ে দেয়। যাহ্ ডাক-, বল দুলাভাই ডাকে, যা বলগে। দেখবি এসে পড়বে!
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মাসুম ম্যাসেজটা খুলে দেখে।
ম্যাসেজ:-
“খুব সুন্দরী সফল ক্যারিয়ারের নারীকে দেখেছি ডিভোর্সি হয়ে যেতে।
অতি সুখী দম্পতিকে দেখেছি নিঃসন্তান থেকে যেতে শত চেষ্টার পরেও।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সফল পেশায় থাকা মানুষটিকে দেখেছি সুইসাইড করতে।
অনেক ফ্যামিলির উচ্চশিক্ষিত সুন্দরী তরুনীকে দেখেছি বয়স ৪০ এর কোটায় চলে গেলেও পার্টনার না খুঁজে পেতে।
আবার অতি কুৎসিত মেয়েটিরও দেখেছি অত্যন্ত ভাল পার্টনার এসেছে জীবনে।
একদম ফার্স্ট গার্ল মেয়েটাকে দেখেছি একদম হাউজ ওয়াইফ হয়ে থাকার ডিপ্রেশন বুকে নিয়ে বেড়াতে।
আবার অতি ব্যাক বেঞ্চার মানুষটিকেও অনেক সময় দেখেছি সাফল্যের চুড়ায় উঠতে।
আসলে মানুষ এর জীবনে সুখ, সফলতা, ভাল পার্টনার, এসব কিছু কিন্তু সৌন্দর্য্য, মেধা, ভাল ক্যারিয়ার এসবের উপর নির্ভর করে না।
একসময় সবচেয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানুষটিও এগিয়ে যেতে পারে।
আবার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষটিও দিন শেষে ব্যর্থ হতে পারে।
বিসিএস হয়ে যাওয়া মানেই এই না সেই সবচেয়ে সফল ব্যাক্তি।
সবচেয়ে সুন্দরী হওয়া মানেই এই না সেই সবচেয়ে ভাল পার্টনার পাবে।
ফার্স্ট স্টুডেন্ট থাকা মানে এই না সেই সবচেয়ে ভাল চাকরী পাবে।
জীবনের এই প্যারামিটারগুলো আমরা ফিক্সড করতে চাই।
কিন্তু আমরা জানিনা এই ফিক্সড করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই।
কারন আল্লাহপাকই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।
আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হউন।”
প্রথম দু’টি উক্তি মাসুমকে ভাবিয়ে তোলে। খুব সুন্দরী সফল ক্যারিয়ারের নারীকে দেখেছি ডিভোর্সি হয়ে যেতে! অতি সুখী দম্পতিকে দেখেছি নিসন্তান থেকে যেতে শত চেষ্টার পরেও! শত চেষ্টার পরেও? ডিভোর্সি হয়ে যেতেও দেখেছি? আশ্চর্য মাসুম। তার চোখ দুটো তো চড়কগাছ! কি মূল্যবান উক্তি? মানুষ এ-তো রিসার্চ করে! এ্যাতো সুন্দর, চমৎকার উক্তি! আমি তা’ইলে অমন শুরু করছি ক্যান্! থাক সব, থেমে যাই? হ থেমেই যাও। ডাক্তার বৈদ্যের সঙ্গে, ঝাড়ফুঁকের সঙ্গে হাত মিলাও দাদা..!ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ, ডাক্তার..! দেখ কিছু মিলে কিনা!
এমন সময় নতুন সাজে সুলতানা মিহি এসে পড়ে। নিজে নিজে কি কথা বলো? কিছু মিললো! আরে দাদা মিলবে না, মিলবে না। এটা আমার সমস্যা, ডাক্তার আমাকে ফিসফিস করে যা বোঝাতে চাইলো, সমস্যা তোমার না, আমা.. র, বুঝলে..? কি বুঝলে! আরে অমন হা করে দেখছ কি?
সম্বিত ফিরে এলে অমন হা করে থাকা অবস্থা থেকে মাসুম বেরিয়ে আসে, আর মিহি সুলতানাকে নতুন শাড়ি, লাল লিপস্টিকে দেখে মাসুম আশ্চর্য হয়। একটু আগে লুচ্চা বলে গালি দিয়ে গেলো, ঠাস্… দরজা বন্ধ করলো, আবার চা পাঠিয়ে দিলো? আশ্চর্য মিহি! আশ্চর্য চরিত্র তার? বুঝে ওঠতে পারেনা মাসুম। ডাক্তার মিহিকে তাহলে বলেই দিয়েছিল! ডাক্তার সামন্ত সিং, যে কিনা সামন্তবিহীন, নিষ্কর্মা-, আমাকে একটা সন্তান দিতে পারলোনা। এ্যাতো টাকা পয়সা দিলাম, জায়গাজমি বিক্রি করে নিঃস্ব হলাম-! ডাক্তারের ছবি, ডাক্তারের চেম্বার, আর মিহির সঙ্গে ফিসফিস কথা তার কানে এখনো বাজে। যা সন্দেহ করলাম, হলোও তা-ই? শালা..! শব্দ করে মাসুম স্বগতোক্তি করে।
মিহি সুলতানা – আরে আবার শালা! কারে শালা বললে? আমি তোমার শালা! পাগল নাকি!