নিচে (নাকি) নীচে
—————————————
ফেসবুকে শুধু নয়, একালের সাহিত্যে অহরহ ‘নিচে’ – এই ভুল প্রয়োগ চোখে পড়বে। কোভিড-১৯ এর মতোই এই ‘নিচে’ ভাইরাস আজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ‘নিম্ন’ বা ‘নিম্নস্থান’ অর্থে ‘নিচে’ শব্দটির পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন বলে তা গ্রহণীয়। কিন্তু বিষয়টি ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’র কোনও নিবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে প্রখ্যাত বানানবিদ মনীন্দ্রনাথ ঘোষ (কবি শঙ্খ ঘোষের পিতা) তাঁর ’বাংলা বানান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি পত্রে (১৩৪২ সালে প্রকাশিত ’বাংলা শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত) সংস্কৃত শব্দ ’নীচ’-এর অর্থ শুধু mean (হীন) এবং ‘নিচে’-কে প্রাকৃত বাংলা শব্দ ও এর অর্থ ‘নিম্ন/নিম্নে’ বলে উল্লেখ করেন। ঘোষবাবু অবশ্য বিভিন্ন সংস্কৃত শ্লোকের সূত্র টেনে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য খণ্ডন করে ’নীচ’-এর একটি অর্থ যে ‘নিম্ন’ এবং একই অর্থে ‘নিচে’ শব্দটি যে ভুল তা প্রমাণে সচেষ্ট হন।
রাজশেখর বসু, যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সংস্কার সমিতির সভাপতি, তাঁর ’চলন্তিকা’ অভিধানে ‘নিচ/নিচে’ শব্দ স্থান দেননি। ’চলন্তিকা’য় ’নিম্ন’ ও ’হীন’ উভয় অর্থেই ‘নীচ’ শব্দটি সংকলিত করা হয়েছে। সেখানে অবশ্য ‘নীচু’ ও ’নিচু’ – দুটো বানানই আছে। অপর দিকে, পুরাতন ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে’ ( তৃতীয় সংস্করণ, আগস্ট, ১৯৭১) ’নিম্ন’ অর্থে ’নিচ’ ও ’নীচ’ –দুটোই আছে। এই অভিধানে ’নিচ’কে বলা হয়েছে প্রাদেশিক শব্দ। প্রাদেশিক শব্দ হলো সংস্কৃত বাদে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যে শব্দ পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় প্রবেশ করেছে। ’সংসদ অভিধানে’ অবশ্য ’নীচ’ ও ’নীচু’ – দুটোই আছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশাল বাংলা অভিধান ’বঙ্গীয় শব্দকোষে’ আবার ’নিচ’, ’নিচে’ ও ’নিচু’ শব্দ নেই, ’নীচ’ ও ’নীচু’ আছে। এই অভিধানে ‘নিম্নস্থানস্থিত’ অর্থে ’নীচ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রভক্ত ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পবিত্র সরকারও তাঁর অভিনব বানান অভিধান ‘বানান-বোধিনী’-তেও ’নীচ’, ’নীচু’ ও ’নীচে’ সংকলিত করেছেন, ‘নিচ’, ’নিচু’, ’নিচে’ নয়।
রবীন্দ্রনাথ ’বাংলা শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত এক পত্রে ’নিম্ন’ অর্থে ’নিচে’ শব্দের পক্ষে বক্তব্য দিলেও, তাঁর বিভিন্ন রচনায় একই অর্থে ’নীচে’ শব্দটি ব্যবহার করেন। বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত ’রবীন্দ্ররচনাবলী’ হতে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো :-
”জানালার নীচেই একটি ঘাট-বাঁধানো পুকুর ছিল। (’জীবনস্মৃতি’)
”শচীশ কহিল, ‘তাকে আনিয়াছি, সে নীচের ঘরে বসিয়া আছে’।” (’চতুরঙ্গ’)
”হেথা-হোথা পলিমাটিস্তরে
পাড়ির নীচের তলে
ছোলা-ক্ষেত ভরেছে ফসলে।” (’মানসী’)
এখন আসুন, বাংলাদেশের অভিধানগুলো এ ব্যাপারে কী বলে? ’বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ ‘নিচ’ শব্দকে অশুদ্ধ প্রয়োগ (অশুপ্র) বলেছে এবং ‘নিচে’ বলে কোনও শব্দ সংকলিত করেনি। তবে সেখানে ’নিচু’ ও ’নিচা’ শব্দ দুটোও আছে, যে-গুলোর উদ্ভব সংস্কৃত ’নীচ’ শব্দ হতে দেখানো হয়েছে। ’বাংলা একাডেমি সহজ বাংলা অভিধানে’ও ’নিচ’ ও ’নিচে’ নেই, ’নিচু’ ও ’নিচা’ আছে। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ’বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ’নিম্ন’ অর্থে ’নিচু’ ও হীন অর্থে ’নীচ’ আছে, ’নিচ’ ও ’নিচে’ নেই। কিন্তু একই সংকলয়িতার ’বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধানে’ ’নিচু’, ’নিচ’ ও ’নিচে’ –এগুলোর কোনওটিই নেই। তা হলে জানা গেল, ’নিচ’ ও ’নিচে’ বলে কোনও শব্দ কোনও অভিধানেই নেই। এগুলো অশুদ্ধও বটে। কেন অশুদ্ধ, তা-ই বলছি।
’নীচ’ তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ, অটবী/অটবি, তরী/তরি, ধমনী/ধমনি, বেদী/বেদি ইত্যাদি তৎসম শব্দের মতো এর হ্রস্ব বিকল্পও নেই। তাই এর বানান অবিকৃত থাকবে এবং দীর্ঘ ঈ-কার দিয়েই হবে। উল্লেখ্য, ’বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার প্রথমেই বলা হয়েছে, “তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে।” তা ছাড়া, ’পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ গৃহীত বানানবিধিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ”হ্রস্ব বিকল্প না থাকলে তৎসম শব্দের বানানে দীর্ঘ স্বরচিহ্নই লিখতে হবে।” তাই, রবীন্দ্রনাথ বা অন্য লেখকের দোহাই দিয়ে ‘নিচে’ লেখা সংগত নয়। বর্তমানের খ্যাত বা স্বল্পখ্যাত কয়েকজন লেখকের অনুসরণেও ভুল করা যাবে না। ভুল কখনও আধুনিকতার পরিচায়ক নয়।
‘নীচ’ শব্দের সাথে ’এ’ বিভক্তিযোগে ‘নীচে’ (নীচ+এ) হয়। বিভক্তি যুক্ত হলে শেষ বর্ণ ছাড়া শব্দের অন্য সব বর্ণের কার-চিহ্নের কোনও পরিবর্তন হয় না, যেমন : ধীর+এ=ধীরে, নীরব+এ=নীরবে (ধিরে বা নিরবে নয়)। অতএব, ‘নীচে’ ব্যাকরণসম্মত বলে গ্রহণীয় এবং ‘নিচে’ অভিধানবহির্ভূত ও অশুদ্ধ। অন্য দিকে, ’নিচু’ ও ’নিচা’ লেখা যায়; ’নীচ’ শব্দ থেকে এ দুটো তদ্ভব শব্দের উৎপত্তি। উল্লেখ্য, প্রমিত নিয়মে অতৎসম শব্দ কেবল হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লিখতে হবে।
নীচ দিয়ে গঠিত শব্দ : নীচকুল, নীচকুলোদ্ভব, নীচাশয়, নীচতা, নীচত্ব, নীচেকার, উপরনীচ, উচ্চনীচ, নীচতলা, নীচযোনি, নীচগ (নিম্নগামী)।
২১১ বার পড়া হয়েছে