ধ্রুব এষের আকন্দ সারপ্রাইজ
হুমায়ূন কবীর ঢালী
ঢাকা থেকে লঞ্চে গ্রামের বাড়ি গেলে সটাকি লঞ্চঘাটে নামতে হয়। এরপর সটাকি থেকে রিকসা-স্কুটার কিংবা নৌকাযোগে বাড়ির ঘাটে। আমরা উভয় মাধ্যমেই যাতায়াত করে থাকি। এটা নির্ভর করে আবহাওয়া ও ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজের উপর। এবার নৌকায় বাড়ি গেলেও ফিরেছি ব্যাটারি চালিত স্কুটারে। আমাদের স্কুটারে যাতায়াতের রাস্তাটি মূলত মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধ। মানে এটি হচ্ছে দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্পকে রক্ষার বাঁধ। পরবর্তীতে যাতায়াতের রাস্তা। যে বাঁধ মতলব থানাকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে। মতলবের চারপাশেই নদী। অর্থাৎ আগে জলযানে একপাশ থেকে যাত্রা শুরু করে ঘুরে আবার সেখানেই আসা যেত। এখন স্থলপথেও তদ্রুপ চক্কর দেওয়া যায়।
যে কথা বলছিলাম, বাড়ি থেকে স্কুটারে সটাকি লঞ্চঘাটে আসার সময় চোখে পড়ল রাস্তার দুপাশে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের সারি। উদ্ভিদের অগ্রভাগে সাদা ও বেগুনি রঙের ফুলের বাহার। ভাবখানা এমন যে, এই বেড়িবাঁধ তৈরি করাই হয়েছে এসব উদ্ভিদের দাপুটে বেড়ে ওঠার জন্য। মাঝে মাঝে এদের দাপট কমে যায় কিষাণিদের রান্নার খড়ি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এরা দমে যাবার উদ্ভিদ নয়। যতই কাটাকুটি করা হোক, সগৌরবে ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যায়। কারণ এই উদ্ভিদটির নাম আকন্দ। বৈজ্ঞানিক নামঃ Calotropis gigantea, C. procera। Magnoliopsida শ্রেণিভূক্ত। পরিবার Apocynaceae।
আকন্দ এক প্রকার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছ সাধারণত: ৬-৭ মিটার পর্যন্ত উচুঁ হয়ে থাকে। আকন্দ দুই ধরণের গাছ শ্বেত আকন্দ ও লাল আকন্দ। শ্বেত আকন্দের ফুলের রং সাদা ও লাল আকন্দের ফুলের রং বেগুনি। ফুলের ভারে অনেক সময় আকন্দের কান্ড নুইয়ে পড়ে।
গাছের পাতা অনেকটা বট পাতার মতো দেখতে। গাছের কান্ড ভাঙলে কিংবা বোটাসহ পাতা ছিঁড়লে দুধের মতো কষ বের হয়। কারণ, পাতায় এনজাইম সমৃদ্ধ তরুক্ষীর বিদ্যমান। এতে আছে বিভিন্ন গ্লাকোসাইড, বিটা-এমাইরিন ও স্টিগমাস্টেরল। পাতা মরে গেলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আকন্দের ফল সবুজ। অগ্রভাগ দেখতে পাখির ঠোটের মতো। বীজ লোমযুক্ত। বীজের বর্ণ ধুসর কিংবা কালচে হয়ে থাকে।
বহু রোগের নিরাময়কারী ওষুধ হিসাবে আকন্দের ব্যবহার বাংলার ঘরে ঘরে সুপরিচিত । বিজ্ঞানীদের মতে, এর দু’টি প্রজাতি রয়েছে , কেলোট্রপিস গাইগেনটিয়া এবং কেলোট্রপিস প্রসেরা । ওষুধ হিসাবে আকন্দের ভেষজ ব্যবহার বিষয়ে আয়ৃর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসায় উল্লেখ রয়েছে । হাঁপানি, পেট খারাপ, অর্শ, ব্রণ, বিছের কামড়, কোষ্ঠকাঠিন্য, বুকে সর্দি , সন্নিপাত, খোসপাচড়া, একজিমা ও দুষ্ট ক্ষতে আকন্দের পাতা, কান্ড ও মূলের ব্যবহার রয়েছে। অনেক ভেষজ চিকিৎসক মনে করেন, উদ্ভিজ্জ ভেষজের শ্রেণী বিন্নাসে আকন্দের স্থান প্রথম সারিতে।
শিশুবেলায় খেলাধুলা করতে গিয়ে শরীরের কোথাও ব্যথা পেলে দেখতাম, আমাদের মুরব্বীরা আকন্দ গাছের পাতা এনে হালকা গরম করে সেক দিতেন। ব্যথা ভাল হয়ে যেত। এখনো গ্রামের মানুষ অসুস্থ হলে এই জাতীয় ওষধি গাছের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার,নেপাল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া আর থাইল্যান্ড এ এই গাছ অঢেল। মজার ব্যাপার- থাইল্যান্ডে, আকন্দ ফুল ভালোবাসার প্রতীক। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে এই ফুল ব্যবহারের চল রয়েছে। নানা ঔষধ গুণের সুবাদে এর বাণিজ্যিক চাষ হয় ।
কবি-সাহিত্যিকদের কলমেও উঠে এসেছে আকন্দের নাম। কবি জীবনানন্দ দাশ তার রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের এখানে আকাশ নীল কবিতায় আকন্দ ফুলের বর্ণনা দিয়েছেন…
‘আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ’।
আরেক কবিতায় উল্লেখ করেছেন…
‘চারিদিকে বাংলার ধানি শাড়ি-সাদা শাঁখা-বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মাঠ-আপনার মনে
ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস…’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার বনবাণী’তে আকন্দ ফুলের উল্লেখ করেছেন।
‘বকুল, শিমুল, আকন্দ ফুল
কাঞ্চন জবা রঙ্গণে
পুজা তরঙ্গ দুলে অম্বরময়।’
লেখাটি শেষ করি প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষের বিষয় দিয়ে। দুই বছর আগে ধ্রুব এষ গিয়েছিলেন আমাদের গ্রামে। ফিরছিলাম বেড়িবাঁধের রাস্তা দিয়ে। তখনও দুপাশে ছিল আকন্দের পাথার। শেষ বর্ষার সময়। পুরনো পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ছিল। কিছু ঝরে পড়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। ধ্রুব এষের চোখ গেল আকন্দের হলুদ পাতার দিকে। কিছু সময় কী যেন ভাবলেন। এরপর কয়েকটি হলুদ পাতা ছিঁড়ে বসে গেলেন পিচঢালা কালো রাস্তায়। আমি, শিশুসাহিত্যিক আশরাফুল আলম পিনটু ও আহমেদ রিয়াজ দেখছিলাম তার কাণ্ডকীর্তি। ধ্রুব আকন্দের হলুদ পাতা দিয়ে নানাভাবে পাখি বানালেন। আমাকে বললেন, ঢালী ভাই ছবি তুলেন ত। ঢাকায় গিয়ে আমাকে এই ছবিগুলো দিয়ে দেবেন।
আমি ছবি তুললাম। ঢাকায় এসে ছবিগুলো দিয়েও দিলাম। পরের বছর বিশ্বসাহিত্য ভবন থেকে আমার কিশোরসমগ্র এক প্রকাশ হবে। ধ্রুব এষকে বললাম প্রচ্ছদ করতে। ধ্রুব এষ প্রচ্ছদ করে দিলেন। প্রচ্ছদ দেখে ত আমি থ। আকন্দের পাতা দিয়ে বানানো সেসব পাখিগুলো ঠাঁই পেয়েছে আমার কিশোরসমগ্রের প্রচ্ছদে। কী দারুণ! কী দারুণ!
আমি পেলাম আকন্দ-সারপ্রাইজ।
আর পাঠকদের জন্য সারপ্রাইজ ধ্রুব এষের করা কিশোরসমগ্রের প্রচ্ছদ। বইটি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য ভবন থেকে।
কিশোরসমগ্র
লেখক: হুমায়ূন কবীর ঢালী
প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য ভবন
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
বিনিময় মূল্য: ২৫০
First Published : 25 July 2015
১ Comment
very good job; congratulations.