এক শরৎ প্রভাত
লেখক: দেবাশীষ দাস
তারিখ: আগস্ট ১৮, ২০২১
রাজুদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মনু নদী। রাজুদের বাড়ির পশ্চিম দিকে মনু নদীর এক বিশাল বালুচর রয়েছে। এই বালুচর চাষবাসের অযোগ্য ছিল। তবে ঘাস এবং বেশকিছু ঝোপঝাড় ছিল, গরু ছাগল চড়ানোর উপযুক্ত ছিল। বালক রাজু প্রতিদিন বিকেল সেখানে গরু চড়াতে যেত। রাজুদের তিনটি গাভী ছিল, চার/পাঁচ টা বাছুর ছিল। রাজুর সাথে রাজুর বন্ধুরাও প্রতিদিন সেখানে গরু চড়াতে যেত। অনামিকা লাবণ্যা তুলসী ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত বিনোদ কামিনী শুক্লা প্রকাশ এরা সবাই রাজুর বাল্যবন্ধু। সবাই রাজুর প্রতিবেশী এবং সমবয়সী। সকালবেলা সবাই একসাথে স্কুলে যেত। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি সবাই মিলে খেলাধুলা করত। দুপুর বেলা সবাই মিলে মনু নদীর জলে স্নান করত। নদীতে ওরা ততক্ষণ পর্যন্ত স্নান করত যতক্ষণ না ওদের কোনো একজনের মা লাঠি নিয়ে নদীতে গিয়ে ওদের জল থেকে উঠে আসতে তাড়া দিচ্ছে। স্নান করে বাড়ি ফিরে রাজু মায়ের হাতে রান্না করা মাছের তরকারি দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম করত। বিকেল বেলা রাজু এবং রাজুর বন্ধুরা সবাই নদীর চরে গরু চড়াতে চলে যেত। রাজুর সব বন্ধুর গরু ছিল না। কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে সবাই মাঠে হাজির হতো। গরু চড়ানোর পাশাপাশি ওরা সবাই মিলে খেলাধুলা করত, খুব মজা করত। বালক রাজুর জীবনে সেই দিনগুলো খুব মনোরম ছিল। সময়ের সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে। রাজু স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন কলেজ ছাত্র। নব যুবক রাজু ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাল্যকালের মেয়ে বন্ধুদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বন্ধুরা বিভিন্ন রকম কাজ কর্মের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেবেলার সেই মজার দিনগুলো আর নেই। গরু চড়ানোর সেই মাঠের অধিকাংশ জমি কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। মাঠের একাংশ যেখানে রাজু এবং রাজুর বন্ধুরা খেলাধুলা করত সেই জায়গা চাষবাসের অযোগ্য রয়ে গেছে। গ্রামের লোকেরা ঐ জায়গাতে গরু বাঁধে। রাজু বেশ কয়েক বছর সেই মাঠের দিকে যায় নি। হঠাৎ একদিন আশ্বিন মাসের এক সকাল বেলা রাজুর বাবা বললেন, ‘চল রাজু গরুগুলিকে পশ্চিমের মাঠে বেঁধে দিয়ে আসি।’ রাতভর বৃষ্টি হয়েছে, বাড়ির আশপাশের জমিতে জল জমে আছে, মনু নদীতেও বান এসেছে। সকালেও মেঘলা আকাশ, সূর্যের তেজ নেই, কিছুক্ষণ পর পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, মৃদু হওয়া বইছে। বাবার সঙ্গে রাজু গরু নিয়ে মাঠে চলেছে। রাজুদের তখন একটি গাভী এবং দুটি বাছুর ছিল। রাজুদের পোষ্য কুকুরটিও তাদের সঙ্গ নিয়েছে।
মাঠের কাছে গিয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই রাজু কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মাঠে এদিকে ওদিকে জঙ্গলি গাছের ঝোপঝাড়, ঝোপঝাড়ের উপর হাওয়ায় দুলছে সাদা কাশফুল। মেঘলা আকাশ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। রাজুর মনে হচ্ছিল ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে কে যেন ওকে ডাকছে। রাজু মনে মনে অনামিকাকে ভালোবাসত, কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি। সেদিন রাজুর মনে হচ্ছিল ওই কাশফুলের ঝোপের আড়াল থেকে অনামিকা তাকে ডাকছে। অনামিকা যেন তাকে ডেকে বলছে, ‘এসো রাজু সাদা কাশফুলের মাঝে, এই মনোরম পরিবেশে, ঐ সবুজ মাঠে বসে আমরা গল্প করি। তোমার হাতে হাত রেখে, তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমরা ভালোবাসার গল্প করবো। একসাথে হারিয়ে যাব আমরা অন্য জগতে, এসো রাজু, এদিকে এসো।’ আবার কখনো মনে হচ্ছিল লাবণ্যা ডেকে বলছে, ‘এসো রাজু, আজ দুজনে মিলে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে নৃত্য করবো। আজ সবকিছু ভুলে, প্রাণ খুলে, এই মনোরম পরিবেশটা উপভোগ করবো, এসো রাজু।’ রাজু যেন কোনো এক রূপকথার দেশে চলে গেছে। চোখের সামনে মাঠের দৃশ্য বাস্তবে এক রূপকথার জগৎ বলে মনে হচ্ছিল রাজুর। এদিকে গরু কোনদিকে যাচ্ছে, বাবা গরুগুলিকে কোথায় বেঁধে দিচ্ছেন, কুকুরটা কোথায় যাচ্ছে, এসব কোনো কিছুইর তার খেয়াল নেই। সে একটি জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কল্পনার জগতে হারিয়ে গেছে। বাবা যখন গরু বেঁধে দিয়ে রাজুর কাছে এসে বললেন, ‘চল খোকা, গরু বাঁধা হয়ে গেছে, এবার বাড়ি চল।’ বাবার ডাক শুনে রাজু হঠাৎ চমকে উঠল, বাবার ডাকে সে যেন স্বপ্নের দুনিয়া থেকে হঠাৎ বাস্তবের দুনিয়াতে ফিরে এল। বাড়ি ফেরার পথে রাজু বারবার পেছন ফিরে মাঠের দিকে তাকাচ্ছিল। সে যেন কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিল না। তার ইচ্ছে হচ্ছিল ঐ মাঠে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে নৃত্য করতে। বাড়িতে ফিরে এসেও রাজু সেই অনুভূতিটা ভুলতে পারছিল না। কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পরও রাজু কোনো ভাবেই সেই অনুভূতিটা ভুলতে পারছিল না। সেই অনুভূতিটা রাজুর স্মৃতিতে ‘এক শরৎ প্রভাত’ হিসেবে গেঁথে রয়েছে।
Tripura, Kolkata, India.