দশ জুলাই ছিল ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মদিন।
এই মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে লেখার যোগ্যতা আমার মোটেই নাই। তবুও বিভিন্ন সুত্র থেকে সংগ্রহ করে কিছু আলোকপাত করলাম। ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন একাধারে একটি আন্দোলন, এক চলন্ত বিশ্বকোষ, একটি কালজয়ী ইতিহাস ।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১০ জুলাই ১৮৮৫ – ১৩ জুলাই ১৯৬৯) ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ও বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ছিলেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই ।
১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে সম্মান-সহ বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) ডিগ্রি অর্জন।
পড়াশোনা শেষ করার পূর্বেই কিছুকাল তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে বেদ পঠনের অনুমতি দেননি পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষের চেষ্টায় ও কলিকাতা উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি বেদপাঠের সুযোগ পান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সালে পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ফ্রান্সের সর্বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে পি.এইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ – ১৯৫৫ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি ১৮টি ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন (এই ভাষাগুলোতে তিনি রীতিমতো পণ্ডিত ছিলেন), ২৭টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন (তার মানে ২৭টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে, পড়তে ও লিখতে পারতেন) এবং ৪০টি ভাষা সম্পর্কে তাঁর ব্যাপক পড়াশোনা ছিল। তিনি সংস্কৃত, প্রাচীন পাহ্লবী, আরবী, হিব্রু, খোতনি, তিব্বতি, পালি ইত্যাদি ভাষা নিয়ে গভীর গবেষণা করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে এবং চর্যাপদ নিয়েও মূল গবেষণা করেছিলেন ভাষা পন্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ । তাঁর মতে বাংলাভাষার উৎপত্তি হলো গৌড়ীয় বা মাগধী প্রাকৃত থেকে। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা নয়, সমগোত্রীয় ও নিকট আত্মীয়। তিনি মনে করেন- বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল সপ্তম শতাব্দী। তাঁর পাণ্ডিত্যের মূল বিষয় ছিল তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত ইত্যাদি তার অমর অবদান। তিনি উর্দু অভিধানও প্রণয়ন করেছেন এবং শ্রীলংকার ভাষার উৎপত্তিও নির্ধারণ করেছেন।
তিনি ১৮টি ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও গভীরভাবে ভালোবাসতেন বাংলাভাষাকে। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন নয় বরং তার কয়েকদিন আগে ১৯৪৭-এর জুলাই মাস থেকেই ছিলেন সোচ্চার। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে এ বিষয়ে তীব্র দাবি উত্থাপন করছিলেন বিভিন্ন প্রবন্ধে ও ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হয়ে উর্দু বা আরবী হলে তা হবে গণহত্যার শামিল। তিনি পাকিস্তান সরকারের সকল প্রকার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার পক্ষে তার সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের জন্য ছিলেন প্রধান প্রেরণা। একুশে ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর তিনিই প্রথম কালো ব্যাজ ধারণ করেন। তাঁর দুই পুত্র মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ও মুর্তজা বশীর দুজনেই ভাষা সৈনিক ছিলেন। শহীদুল্লাহপুত্র মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ছিলেন ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান কর্মী। আর মুর্তজা বশীর ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের (তকীয়ূল্লাহ তখন জেলখানায় রাজবন্দি ছিলেন) অন্যতম প্রধান কর্মী।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একইসঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ এবং ব্যক্তি জীবনে নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তিনি বলেছিলেন ‘হিন্দু মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে কিন্তু তাহা যে করিতেই হইবে।’ তার আশা ছিল ভবিষ্যতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলিত বাঙালি জাতি বিশ্বসভায় ফরাসি, জার্মান জাতির মতো আপন সম্মানজনক স্থান অধিকার করবে। তাঁর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ছিল ‘‘আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে তোমরা পারিবে”।
তিনি আরও বলেছিলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তেমনি সত্য আমরা বাঙালি। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক, টিকিতে অথবা টুপি, লুঙ্গি,দাড়িতে তা ঢাকবার জো নেই’’।
১৯৫০ সালের যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তখন তিনি নিজের বাড়িতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কযেকজন মানুষকে আশ্রয় দেন। শুধু তাই নয়, তিনি চক বাজারের জামে মসজিদে জুম্মার দিন খুতবার সময় বলেন- ‘‘যদি কেউ কোরান শরীফ থেকে প্রমাণ করতে পারে যে, নিরাপরাধ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যার বিধান রয়েছে তাহলে তিনি নিজের নাম পাল্টে ফেলবেন।’’ তিনি তার বাড়িতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলার ঘোষণা দিয়ে বলেন কেউ পারলে আমাকে ঠেকাও । তাঁর এই বলিষ্ঠ বক্তব্যের পর ঢাকার চকবাজারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্পুর্ন থেমে যায়।
ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবেও কিন্তু তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতীম। জীবনে নামাজ কাজা করতেন না। আমৃত্যু রোজা রেখেছেন। হজ্ব করেছেন। অনেক ধর্মীয় সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ঊর্ধতন ১৪তম পুরুষের নাম শেখ দারা মালিক। শেখ পদবী দেখে বোঝা যায় তিনি এসেছিলেন আরব থেকে। সম্ভবত হজরত শাহ জালালের সঙ্গে যে তিনশ আউলিয়া আসেন তাদের অন্যতম শেখ আব্বাস মক্কী (মক্কাবাসী)-র শিষ্য হয়ে শেখ দারা মালিক ভারতবর্ষে আসেন। তিনি দিল্লির দরবার হতে সম্রাট শাহজাহান বা আওরঙ্গজেব-এর কাছ থেকে পরোয়ানা নিয়ে বাংলায় আসেন। সে পরোয়ানায় তিনি চব্বিশ পরগণার বালান্ডা পরগণা লাখেরাজ (করবিহীন) পান। বসিরহাট মহকুমায় এখনও আব্বাস মক্কী (অন্য নাম পীর গোরাচাঁদ) এর কবর রয়েছে। পীরের খাদেম হিসেমে শেখ দারা মালিক সেখানে পীরের মাজারের খাদেম হন। হতে পার এগুলো মিথ তবে শেখ দারা মালিক বসিরহাটের পেয়ারা গ্রামেই থিতু হন। তার পরবর্তী বংশধরেরা এ গ্রামে ও তার আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন। শহীদুল্লাহর একজন পূর্ব পুরুষ ছিলেন মুন্সী শেখ গোলাম আবেদ। তিনি লর্ড অকল্যান্ডের মুন্সী ছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, এই পরিবারটিতে পূর্ব থেকেই বিদ্যাচর্চা ছিল। কারণ তা না হলে মুন্সীর চাকরি পেতেন না। শহীদুল্লার বাবা মুন্সী মফিজুদ্দিনও ছিলেন আদালতের ডিড রাইটার। পরে তিনি ইংরেজ জজের সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আদালতের সামনে বসে দলিল লেখকের বৃত্তি অবলম্বন করেন। মুন্সি মফিজুদ্দিন বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, ও উর্দু এবং উর্দু হিন্দি মিশ্রিত হিন্দুস্থানি ভাষা জানতেন। শহীদুল্লাহর নাম জন্মের সময় রাখা হয়েছিল শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম । কিন্তু তার মা হুরুন্নেসা ছেলের নাম রাখেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সেই নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিত হন।
শহীদুল্লাহ গ্রামের মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং পরে হাওড়া জেলা স্কুলের ভর্তি হন। তিনি ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে বাংলা, উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার মতো অব্রাহ্মণকে (তদুপরি মুসলমান) বেদ পড়তে দিতে রাজি হন না তখন এ নিয়ে প্রচুর বাদ, প্রতিবাদ ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিষয়টির সুরাহা করেন। তাঁর নির্দেশে শহীদুল্লাহ তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই এমএ ডিগ্রি পান (১৯১২)। দুবছর পর তিনি বিএল (১৯১৪) ডিগ্রিও অর্জন করেন।
১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি এতটাই ভালোবেসে ফেলেন যে পরে শান্তি নিকেতন থেকে শিক্ষক হওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম ভক্ত। তিনিই কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে শান্তি নিকেতনে গুরুদেবের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রবল প্রতিবাদীও ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
তিনি ১৯২৬ সালে প্যারিসের সোর্বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ও ডিপ্লোফোন ডিগ্রি পান। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট। তার গবেষণার বিষয় ছিল চর্যাপদ ও বৌদ্ধ দোহা গান। গবেষণাপত্রের নাম ছিল ‘Buddhist mystic song’। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রথম চিন্তক।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছিল মোঠ ৯ জন সন্তান। দুই কন্যা এবং সাত পুত্র। সন্তানরা শহীদুল্লাহকে ডাকতেন ‘বাবু’ বলে। সন্তানদের প্রতি তিনি ছিলেন স্নেহশীল। নিজের ছাত্রদেরও তিনি সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। অনেক দরিদ্র ছাত্রের শিক্ষার ব্যয়ভারও বহন করেছেন তিনি।
অত্যন্ত ভালোবাসতেন বলেই তাঁর মা হুরুন্নেসা নিজের গ্রাম ত্যাগ করে সারাজীবন তাঁর এই ছেলের কাছেই ছিলেন।
শহীদুল্লাহ তাঁর স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন। সংসারের অধিকাংশ কাজে তাঁর স্ত্রীর মতামতই ছিল প্রধান। ব্যক্তি জীবনে ছিলেন খুব সুরসিক। প্রায়ই বলতেন বই এবং বউ তার সবচেয়ে প্রিয়। স্ত্রীর একনিষ্ঠ অনুরক্ত ছিলেন তিনি। নাতি-নাতনিদেরও খুব স্নেহ করতেন।
তাঁর চকবাজারের বাড়িটা ছিল এক বিশাল লাইব্রেরি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন এই ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারেই সর্বদা পাঠে নিমগ্ন থাকতেন। অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে বলা হতো চলন্ত বিশ্বকোষ । তাঁকে জ্ঞানতাপস অভিধায় ভূষিত করেন তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীরা। তিনি অবশ্য নিজের নামকরণ করেছিলেন জ্ঞানানন্দ স্বামী। কারণ জ্ঞানলাভ ছিল তার জীবনের আনন্দের উৎস ও ব্রত।
১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই চব্বিশ পরগণার বশিরহাটে তার জন্ম এবং ১৯৬৯ সালে ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কাছে মুসা খান মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তার অন্তিম শয্যার স্থান। এর পাশের ছাত্রাবাসটির নামকরণও হয় তাঁর নামে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর প্রিয় কর্মস্থল, যেখানে ছিল তাঁর প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা, যার অদূরে রয়েছে তাঁর মানস প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, সেই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন বাঙালি জাতির এই কৃতী সন্তান।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অমর উক্তি, মাতা মাতৃভাষা মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু। এই তিনের প্রতি যার শ্রদ্ধা নেই সে ঠিক মানুষ নয়, মানুষরূপী পশুবিশেষ। মাতৃভাষার প্রতি এই ভালোবাসাই তাঁকে অমর করেছে।
উর্দু ভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবেই বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১ – ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহিত্যঃ-
শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ-
ভাষা ও সাহিত্য
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত
দীওয়ান-ই-হাফিজ(অনুবাদ)
রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম(ভাবানুবাদ)
নবী করিম মুহাম্মাদ(সাঃ)
ইসলাম প্রসঙ্গ
বিদ্যাপতি শতক
বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড)
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
ব্যাকরণ পরিচয়
বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান
মহররম শরীফ
টেইল ফ্রম দি কুরআন
Buddhist Mystic Songs (১৯৬০)
Hundred Sayings of the Holy prophet
ভাষা আন্দোলনে ভূমিকাঃ-
সম্পাদনা বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ও প্রাচ্যে অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র স্মরণীয় উক্তি ছিল
আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী।
পুরস্কার সম্মাননাঃ-
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়।
ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে।
পাকিস্তান আমলে তাকে ‘ প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পদক(১৯৫৮)’ ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করা হয়।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়।
১৯৮০ সালে তাঁকে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের নামকরণ করা হয়।
এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা । আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে জান্নাত নসীব করুন । আমিন ।