ময়ফুলির বসন্তবরণ
–জেসমিন জাহান
সাভারের জিরাবো থেকে বাসে উঠেছি, গন্তব্য বকশীবাজার ঢাকা শিক্ষাবোর্ড। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে নামলে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই হলো, রিক্সায় পাঁচ মিনিটের পথ। এস এস সি পরীক্ষার খাতা আনতে যাচ্ছি। মিটিং দিয়েছে দুপুর ২ টায়। তারপর খাতা হাতে পেতে তিনটা বেজে যাবে। তাই স্টাডি ট্যু্রে যাওয়াটা মিস করতে ইচ্ছে করলো না।
সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বের হয়েছি। স্টুডেন্ট টিচার সব মিলে দশটাবড় বড় বাস। খাবারের সরঞ্জামসহ লোকজন গতকালকে বিকেলেই চলে গেছে। সকালের নাস্তা , দুপুরের খাবার আর বিকেলের হালকা খাবারের ব্যবস্থা। কচ্ছপ গতিতে এগুচ্ছে গাড়ি। বাইরে বাতাস থাকলেও ভেতরটা সবাই মিলে গরম করে রেখেছে, হৈ হল্লা করছে। ঢাকার রাস্তা কে কবে যানজট মুক্ত দেখেছে? একঘন্টা লেগে গেলো টেকনিক্যাল আসতেই। তারপর অবশ্য দেরি হয়নি।
প্রিন্সিপাল বিষয়টা জানতেন তাই দুপুরের খাবারটা আগে ভাগেই আমাকে দেয়া হল। খেয়ে বারটার পরপরই বেরিয়ে পড়লাম।ফার্মগেট আসতে আসতেই দু’টা বেজে গেলো। খামার বাড়ি পার হওয়ার পর গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে কন্ট্রাক্টরকে (সম্ভবত সেও ড্রাইভার) ডেকে ড্রাইভার বলল, “ওস্তাদ, একটা ঘুমদেই জ্যাম ছাড়লে ডাইক্যা দিও”।
আজ পয়লা ফাল্গুন। চারিদিকে রঙের ছড়াছড়ি। দুই রাস্তার মাঝখানের সরু জায়গাটা পার্ক ছিলো, মেট্রোরেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তাই পার্কের ভেতরে যারা পলিথিনের ঘর বানিয়ে ছিলো তারাও চলে এসেছে ফুটপাতে। এমনি একটা ঘরের সামনে তাকাতেই চমৎকার একটি দৃশ্যে চোখ আটকে গেলো। রোগা পাতলা একটা ত্রিশোর্ধ্ব মেয়ের মাথায় ফুলের একটা রিং পরিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছে তের/ চৌদ্দ বছর বয়েসি একটা ছেলে আর বার বার বলছে,“কী সুন্দর আমার মা! কী সুন্দর!”
আমার একেবারে সামনেই ছিলো ওরা। কথাটা শুনে তাকাতেই মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট হলো। খুব চেনা চেনা লাগলো তাকে। চট করে নেমে এলাম বাস থেকে। আধঘন্টার আগে মনে হয় না জ্যাম ছাড়বে। এগিয়ে গেলাম ওদের কাছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি বলেউঠলো,“ম্যাডাম আপনে এইহানে!”
খুব অবাক হলাম, “ময়ফুলি, তুমি এখানে কেনো?”
সাথে সাথে ওর মুখটা বিষন্নতায় ঢেকে গেলো। প্রায় পনের বছর আগের কথা। আমি প্রথম যে চাকরিতে জয়েন করি তা ছিলো মফস্বলের একটা হাইস্কুল, ছেলেদের স্কুল। উপজেলার প্রধান মাধ্যমিক বিদ্যালয় হওয়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। অডিট বা বড় কোনো উপলক্ষে রান্না-বান্না স্কুলেই হতো। কোটা- বাছা করার জন্য স্কুলের দারোয়ানের এই মেয়েটা আসতো। তখন বয়স কম ছিলো সবাই আদর করতো। শুনেছিলাম একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। সে শহরে থাকে অবস্থা মন্দ না, তার সাথেই বিয়ে হবে।
আমি ঢাকায় চলে এসেছি পরের বছরই । ছেলেটা যে ওরই তা বুঝেছি। জিজ্ঞেস করলাম, “এইদশা কী করে হলো তোমার?”
তার কথায় পরিষ্কার হয়ে গেলো সব।
সেই ছেলেটার সাথে সে বেশ গাঢ় সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। একপর্যায়ে ছেলেটা বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় কিন্তু সামাজিকভাবে এরকম জোর করেই বিয়ে হয় ওদের। ভালোই কাটছিলো সময়। ছেলেটা জন্মাবার পর আস্তে আস্তে স্বামীর আসল পরিচয় জানতে পারে ময়ফুলি। ছেলের বয়স দুবছর হলে তাকে মায়ের কাছে রেখে দু’জনে চাকরি করবে বলে ওকে নিয়ে শহরে চলে আসে ওর স্বামী। এখানে সুন্দর একটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই সে বুঝতে পারে তার চাকরিটা কী। পরতিদিন নতুন লোকের আনাগোনা, স্বামীর হাতে পায়ে ধরেও রেহাই পায়নি সে। ধর্মের দোহাই দিয়েও কাজ হয়নি। এ শহরের কিছুই সে চেনেনা। এভাবে কেটে যায় পাঁচবছর। ছেলেকে কাছে চায় ময়ফুলি। অনেক কাকুতি মিনতি ক্রে ছেলেকে আনায় সে। তার স্বপ্ন ছেলে শহরের স্কুলে পড়বে। তার জীবন্টা নরক হয়েছে ক্ষতি নেইছেলেটা মানুষ হোক।ঞ্ছেলে আসার পর কিছুদিন ভালোই ছিলো। আবার একদিন শুরু হলো পুরনো ঘৃণ্য সেই অবস্থা। ছেলে বড় হচ্ছে এইকথা বলে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে বহুবার কোনো কাজ হয়নি।
হঠাৎ একদিন বিকেলে ছেলেটা বাসায় এসে বলে, “মা, চলো আমরা এক জাগায় যামু। এই নরকে আর থাকার দরকার নাই; ব্যাগে কাপড় চোপর গুছায়া নাও”। সে তো অবাক! তাড়া দিলো ছেলেটা আর তখনি বেরিয়ে পড়লো স্টেশনের উদ্দেশ্যে।এই স্টেশন সেই স্টেশন করে এখন ফুটপাত। মা ছেলে দু’জনে যখন যে কাজ পায় করে আর রাত হলে এই পলিথিনের ঘুপচি ঘরে ঘুমায়। এই তাদের শান্তি, ভালোই আছে এখন। ফুটপাতের ঘর মন্দ না মাঝে মাঝে চাঁদাবাজদের যন্ত্রণা ছাড়া ভালোই।
কিছু টাকা দিয়ে আমি তাড়াতাড়ি বাসে উঠে বসলাম। যেতে যেতে ভাবছি, কী বিচিত্র জীবন মানুষের!
১ Comment
very good job; congratulations.