জারুল গাছের ছায়া
(আখতার জাহান শেলী)
মাথার ওপর ভাদ্রের নীল আকাশটা সাদা সাদা বিশাল তুলোর ডাই ভাসা নীল জমিন নিয়ে মনের মধ্যে অনন্ত মুগ্ধতা ছড়ায়। ষাটোর্ধ মিথিলা রহমানের সারা অবয়বে প্রশান্তির ছাপ। ফিনফিনে হাওয়ার মোলায়েম আঁচল চোখেমুখে যেন জননীর আদরের স্পর্শ রাখে। জননীর আদর? একটা প্রশ্ন উচ্চকিত হয় মনের মধ্যে। জননীর আদর সুলভ, বিশাল স্বার্থগন্ধহীন। জন্মসূত্রে চারপাশে অবস্থিত পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে শুনেছেন, জেনেছেন, দেখেছেন। নাড়িছেঁড়া আত্মজের কাছে সবচেয়ে স্বার্থগন্ধ হীন প্রত্যাশাহীন বেহেশতী চিজ জননীর স্নেহ। যেটা তাঁর নিজের কাছে অপর্যাপ্ত পরিমানে বহমান তাঁর দুই কন্যা, তিনপুত্রের জন্য।
আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে থাকেন দোতলার দিকে। যেতে যেতেই চোখে পড়ে একতলার চারফ্ল্যাট ভাড়াটে দের দরোজার সামনে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জুতো স্যান্ডেলের ছড়াছড়ি। মিথিলা জানেন, এদের বাহারি পাপোষের নীচেই পাওয়া যাবে ঘর ঝাঁট দে৪য়া বালুরছোট স্তুপ ।এটা তারা করে রাখে বাড়ির দারোয়ানের প্রাত্যাহিক ঝাঁট দেয়ার সময় সে যেন ধুলাবালিগুলো নিজেই সরিয়ে দেয়। চালাকি৮টা অবশ্য দারোয়ান ধরে ফেলেছে,এবং মালকিনের কাছে (মিথিলা) সরেজমিনে দেখিয়ে নালিশ ও করেছে। বই পড়া, সাহিত্য সংস্কৃতির উচ্চতর বোধ ,পরিশীলিত আচরণের চর্চাকারিণী মিঠিলা ভীষণ বিব্রত বোধ করেন এরকম পরিস্থিতিতে।কি৮ন্তু শেষমেশ তাঁকে এসব পরিস্থিতি ফেস করতেই হয়। পানির কলের মুখটা ঠিকভাবে বন্ধ করছে কিনা সবাই, অযথা পানির অপচয় হচ্ছে কিনা, বাড়ির ভেতর যত্র তত্র আবর্জনা ফেলে নোংরা করা হচ্ছে কিনা ,এসব স্থুল বিষয় গুলো তাকেই দেখতে হয়। তখন প্রথমে যদিও দিশেহারা বোধ করেন, তবে শেষ পর্যন্ত সমাধানটা তিনিই করেন। পরিবারে অন্য সদস্যরা শুধু শুধু শুনেই যায়।
লকটা ঘুরিয়ে দরজা খুলে বাসায় ঢুকতেই চোখে পড়ে স্বামী আজাদ রহমান ও ফিরেছেন মর্নিংওয়াক শেষে।ফ্যানের নীচে গায়ের ঘাম শুকাতে শুকাতে শুনছেন টিভি চ্যানেলের সাম্প্রতিক ক্যাসিনো কান্ডের বিবরণ বিশ্লেষণ।
অশীতিপর বৃদ্ধা মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলেন বিছানার ওপর থেকে উঠে বসেছেন আম্মা মেহারুন্নিসা খাতুন। পা দুটো ঝুলিয়ে মহা বিরক্তমুখে বসে আছেন। কাঁচের মতো স্বচ্ছ উজ্জ্বল চোখজোড়া তুলে চাইলেন বড়কন্যা’ র দিকে। মিথিলা রহমানের চোখজোড়া হাই পাওয়ারে চশমায় ঢাকা, কিন্তু মেহেরুন্নিসা খাতুন তিরাশি বছর বয়সেও চশমা ছাড়াই সব দেখতে পান, পেপার বই পড়তে পারেন।
-আম্মা কী অবস্থা ? শরীরটা কেমন? বলতে বলতে আম্মার ঝুলানো পায়ের নীচে একখানা অনতিউচ্চ প্লাষ্টিক টুল বসিয়ে পা জোড়া সেখানে স্থাপন করে দেন। বহুবার বলা সত্বেও মেহেরুন্নিসা নিজে থেকে এটা করেননা।
– আমার শরীরের খবর কে লয়? আর কইলেই কী অইবো? কপালে করি আইনছি খারাপি, আমারে ত এইটা ভুইগতে অইবো। কী করুম? কী জন্য যানি আল্লায় আমারে অখনো তুলি নেয় না কে জানে?
মিথিলা নীরব থাকেন। এই কথাগুলো বস্তুত নিয়ম করেই তাকে দিনে আট দশবার শুনতে হয়। নীরবে চেক করতে থাকেন মেহেরুন্নিসা খাতুনের ওষুধের বাক্স । বেডসাইড টেবিলে রাখা ট্রেতে চোখ বুলিয়ে দেখেন খালিপেটে খাওয়া দুটো অষুধের খোসা, চিনিছাড়া লিকার চায়ের খাওয়া খালি কাপ, একটা লাক্সাস বিস্কিটের খালি প্যাকেট, নাহ সবই আনিলা ঠিকঠাকমত দিয়ে গেছে। হালকা ডিওডোরান্টের গন্ধ পান। তার মানে প্রাতঃ কৃত্যের ব্যাপার গুলো ও ঠিকমতো সমাধা হয়েছে। হাই প্রেসার ,ডায়াবেটিস, আরথারাইটিস,হাই কোলেষ্টেরল। কিডনি ইনফেকশন , আর আরও নানান সমস্যা মেরুন্নিসা র নিত্যসংগী বহুদিন ধরে। তার ওপর মেহেরুন্নিসার রয়েছে কোনও নিয়ম না মানার প্রবণতা। একটু হাটাহাটি, হালকা ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণের জন্য নিত্যি তার সাথে ছেলে মেয়েদের খিটিমিটি লেগেই থাকে। কোন ও নিয়ম পালনেই তার চরম অনীহা। যার সংগেই কথা বলতে যান, নিজের অসুখ অসুবিধার ফিরিস্তি ছাড়া তিনি আর কোনও কথাই খুঁজে পান না। বড় সন্তান মিথিলা। রাশভারী স্বভাবের এই কন্যাকেই তিনি অনেকটা সমঝে চলেন। নব্বই কেজি ওজন নিয়ে জুবুথুবু অথরবপ্রায় মেহেরুন্নিসা কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সময়নিষ্ঠ। তাঁর কাঁটায় কাঁটায় সকাল ছ ‘ টায় খালিপেটের ওষুধ, লিকার চা ক্র্যাকারস , সকাল আটটায় পূর্ণ নাশতা, বেলা সাড়ে দশটায় দীর্ঘসময় ব্যাপী বিভিন্ন পরিচর্যা সহ গোসল,সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ হালকা খাবার ,কাঁটায় কাঁটায় বেলা দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে দুপুরের খাবার,বিকেল পাঁচটায় আবার অল্প কিছু খাওয়া, সবশেষ রাত আটটার মধ্যে রাতের খাবার । অতন্দ্র নির্ভুল তার এই নিয়মাবলীর সময় ঘড়ি। মিথিলা রহমান আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছেন আশেপাশের পরিবেশের কোনও ই ঘটনা, দুর্ঘটনা, বিপদাপদ, ব্যস্ততায় ও তাঁর আম্মা মেহেরুন্নিসা এসব নিয়ে নিরবিকার থাকেন। দিন পনেরো আগে তাঁর মেয়ে জামাই , নাতির প্রবল ডেংগুজ্বরের সময় ও নিজের বাঁধা নিয়মের এতটুকু ছাড় দেননি। প্রীতম, এবং আজাদ সাহেবকে নিয়ে মিথিলা রহমান যখন বাড়ি- হাসপাতাল , হাসপাতাল – বাড়ি করছিলেন, তখন চরম বিশৃঙ্খলায় পড়ে পুরো বাসার কাজকর্ম নাওয়া খাওয়া । ছুটা দুটো বুয়া নিয়ে মিথিলা রহমান ও আনিলা’ দের শাশুড়ি বউয়ের নাভিশ্বাস ,তখনও মেহেরুন্নিসা খাতুন কেঁদেকেটে চীৎকার চেঁচামেচি করে একাকার করেছেন। এবং সেটা মুমুরষ মেয়ে জামাই নাতির জন্য নয়, তাঁর রুটিন বাঁধা শুস্রষাগুলোর বাত্যয় হয়েছিলো বলে।
মেহেরুন্নিসা বিরক্ত গলায় মেয়েকে বললেন – বাসায় কেউ নাই নাকি? সকাল হইতে কেউরে দেখলামনা? বেলা হইতে চললো দুপুর। আইজ তো মনে হয় নাস্তা মাস্তা দিবা না!
লাগোয়া ব্যালকনীতে চড়ুই-এর কিচিরমিচির, মৃদু হাওয়ার দোলায় দোলায়িত অপরাজিতার নীল সাদা উকিঝুকি ।অনেক সৌন্দর্যের মধ্যেও মিথিলার মাথাটা গরম হয়ে যায়।
বেলা বাজলো সাতটা পঞ্চাশ,এখনো আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। কেউ যদি না ই থাকে তবে কী আসমানী ফেরেস্তা নাজেল হয়ে আপনার ওষুধ, চা বিস্কিট এসব দিলো নাকি ? আমিও তো এলাম আপনাকে নাশতার টেবিলে নিতে।ছোটলোকের মেয়ে তো ছিলেননা যে
জন্মে মধু পান নাই।কথাবার্তা এমন কেনো আপনার?
একটু মিইয়ে যান মেহেরুন্নিসা খাতুন। লাগোয়া ব্যালকনির দিকে তাকালেন।ভাদ্রের সকালের
প্রথম রোদে ভরে আছে সেটা। একখানা প্লাষ্টিকের খান্দানি চেয়ার ও সেখানে রাখা থাকে। তাঁর বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। সারাটা সকালই এই ব্যালকনীটায় বিছানো থাকে উজ্জ্বল রোদ। মেহেরুন্নিসা এটাও জানেন,নীচের বড় জারুল গাছটা বেলা বাড়লে ঝাঁঝালো রোদটাকে আড়াল করে দাঁড়ায় । ঐ জারুল গাছের ছায়ার মায়াটাই তখন পুরো ব্যালকনীর অধিকারটা নিয়ে নেয় ।মিথিলার বাড়ানো হাতটা ধরে ভারী জগদ্দল শরীরখানা নিয়ে উঠে দা দাঁড়াতে গিয়ে ককিয়ে ওঠেন । পিঠ ,কোমর্ , হাঁটু সব যেন মরচে পড়া যন্ত্রাংশের মতো ক্যাঁচক্যাঁচ করে বিদ্রোহ করে। তবুও জীবনের জন্য বড় মায়া। ছেলে মেয়েরা কতো দুরে দূরে থাকে একেকজন। পাঁচ ছেলেমেয়ের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে তাঁর মুসাফির জিন্দেগী এখন। খুব সাধ হয়, স্বপ্ন দেখেন – আহারে এমন হইতে পারেনা? তারা সবাই ছোট হইয়া গেলো। ছোট ছোট দুই তিন বছরের ছোটবড় পাঁচটা ছেলেমেয়ের হুড়োহুড়ি উঠোনের নরম রোদের পৌষালি সকালটাকে আর ও ওম ওম করে তুলেছে।উঠোনে খেজুর নারকেল পাতার বেড়া দেয়া অস্থায়ী রান্নাঘরে তিনমুখো খড়ির চুলায় জ্বলছে শুকনো ডলপালা ,ডাব নারকেল খোলের আগুন। এক মুখে টগবগ করে ফুটছে চায়ের পানি, অন্য দুই মুখে বসানো মাটির খোলায় তৈরি করছে দুজনে চিতই পিঠা। একটা বড় মাটির দুহনিতে কোরানো নারকেলের স্তুপ।আরেকটা বড়ো বাটিতে ঢালা আছে খেজুরের গুড়। তাতে চামচ দেয়া। একপাশে মাঝারি বড় পাতিলে ভর্তি তেলঝাল মশলায় রান্নাকরা ঘরে পালা খাসী মুরগীর লোভনীয় লাল বর্ণ সালুন। চিতই পিঠার জালি জালি হালকা ঘিয়েরং গোলগোল অবয়ব গুলো ভরে তুলছে বাঁশের তৈরী সাজি গুলো। পাশেই পেতে রাখা মোড়া ,মাদুরে দু তিনজন করে খেয়ে খেয়ে চলে যাচ্ছে। পৌষের শীতে ও কপাল ভিজে গলা বেয়ে ঘাম নামতো। গায়ের মোটা সুতী চাদর অথবা ফুলহাতা ‘চুলি ‘ টার ততক্ষণে জায়গা হতো খেজুর পাতার বেড়ার ওপর।কালিঝুলি মাখা লুসনি থেকে আংগুলে লাগা কালিতে মাখামাখি হতো কপাল ও। ঘাম মুছতে গিয়ে শশ্বুর ,ভাসুর, স্বামী সবাই বলতো- তুমি কতক্ষনে খাইবা গো ? খাইয়া লও ।
সহাস্য মুখে আরক্ত মৌনতায় তাঁর মনে থাকতো অপার প্রশান্তি।মৃদু হাসতেন শুধু। গোগ্রাসে খেয়া পরিতৃপ্ত সক্কলের শেষে হাতমুখ ধুয়ে অবশিষ্ট ঝোলে ডুবিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পিঠে খাওয়ার মধ্যেও বড়ো সুখ ছিলো। শান্তি পেতেন।
এখন ঝকঝকে ডাইনিং টেবিলে গোছানো টিপটপ ঝকমকে চীনেমাটির প্লেটে সাজানো লাল আটার দুখানা পাতলা রুটি, কুসুম ছাড়া ডিম, তেলবিহীন রংগীন সবজী রান্না, সেদ্ধ, ঝাল মশলা বিহীন বাচ্চা মুরগীর ঝোলে জীবনকে টেনে নিয়ে চলছেন কতোদিন! সারাক্ষণ মেজাজটা চড়ে থাকে। এমন কপাল- আলসারের ব্যথা, হাই প্রেসার, হাই কোলেস্টেরল, সুগার সমস্যা কতো কী যে তাঁর নিত্যসংগী থাকে! এরা তাঁর সংগে নিয়মিত শ্ত্রুতা করে যাচ্ছে। নাশতার টেবিলে প্রত্যেক বেলায় নিমতিতা মুখ করে তাঁকে নিয়ম করে এই অখাদ্যগুলো গিলতে হচ্ছে। চেষ্টা করেন সব সমস্যাগুলো লুকিয়ে চলতে, কিন্তু ওরা প্রায় প্রতিদিনই ভোরবেলা খালিপেটে আংগুলে সুঁই ফুটিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে, মেশিন লাগিয়ে প্রেসার চেক করে সব জেনে ফেলে। প্রায় প্রতি মাসেই হাসপাতাল-ডাক্তার নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে সবাই বিরক্ত হয়রান। মেহেরুন্নিসা দেখতে পান বড়মেয়ে মিথিলা, ছেলে রাজন, ছোটমেয়ে শায়লার বিপন্ন বিধ্বস্ত মুখ। পুত্রবধূ নাইমার কপালে বিরক্তির ভাঁজগুলো সে আর এখন লুকায়না। একমেয়ে সোহেলা, ছোটছেলে নিজাম বহুবছর ধরে আমেরিকায়। সেখানেও অনেক ঝামেলা করে তাঁকে নেয়া হয়েছিলো, কিন্তু সবাইকে অস্থির বিরক্ত করে চীৎকার কান্নাকাটিতে সবার ঘুম হারাম করে একমাসের মধ্যে তিনি চলে এসেছেন। প্রবাসী দুই ছেলেমেয়ে ,তাদের পরিবারের সবার চোখেমুখে তিনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন স্বস্তির আর হাঁপ ছেড়ে বাঁচা শান্তির ছাপ। এখন কালেভদ্রে ফোন করে আর টাকা পাঠিয়েই ওরা দায়মুক্ত হয়। তবুও মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন,দুটো মেয়ে আছে বলেই এখনও তিনি মানুষের জীবনে আছেন। নইলে—। আজ পানি পোচ ডিমে কুসুমটা শুদ্বুই দিয়েছে। ভাজি নামের সেদ্ধ সবজির সাদা রঙ চীনামাটির বাটিটা তুলে আছাড় মারতে ইচ্ছে করছে । কতোদিন বেশি তেলে ভাজা ফুলে ওঠা পেঁয়াজ কাঁচামরিচ ধনেপাতার মিশেলে একখানা নধর ওমলেট খেতে পান না ! গাওয়া ঘিয়ে ভাজা চিকন সুগন্ধী চাল মসুর ডালের খিচুড়ি, সাথে গরুর গোস্ত ভুনা।অতীতে ফিরে গিয়ে মনছবি থেকে তুলে নেন মনে মনে – গরুর দিধ ঘন করে তৈরি হালকা ঘিয়ে রংগের অপূর্ব স্বদের পায়েস। লোহার কড়াইয়ে উপচানো ফুটন্ত তেলে ফুলে গোল টপটুপে হয়ে ওঠা পোয়া পিঠে গুলো যেন জীবন্ত ছবি হয়ে ওঠে কার্ত্তিক আঘ্রাণ মাসের ঢিমে আঁচের কাঠকয়লার উনুনের ঘ্রাণসহ। বড়োজামাই আজাদ রহমান স্মৃতিচারন করেন প্রায়ই – বুঝলে প্রীতম ,পিঠা করতেন তোমার নানু, অপূর্ব ছিলো সেসব পিঠের স্বাদ।আহা, সব রান্নাই বিশেষ করে রিচ ফুডগুলো—ওরকম আর কারুরই হয়না। খাইয়েছেন আমার শাশুড়ি– আলহামদুলিলাহ।
মিথিলা রহমান জানেন সেকথা, মানেন ও। কিন্তু এই ছোট হয়ে আসা জীবনের গন্ডী’তে আজকাল আর সেই তেল ঘি মশলার প্রাচুর্যঘন মোগলাই রান্না খেলে আর দেখতে হবেনা ! তাই ওই ঘরানার রান্নার উত্তরাধিকারী হয়ে ও তিনি পারতপক্ষে ওপথ মাড়াননা। যা যুগ পড়েছে ,ভ্যাজাল আর বিষময়তার এ সময়ে যতটুকু পারেন স্বাস্থ্যসচেতনতার রাস্তায়ই থাকতে চেষ্টা করেন। কালেভদ্রে বিশেষ দু একদিনের মেহমানদারিতে মিথিলা আম্মাকে অনুসরন করেন। কিন্তু আম্মার খাবারের বেলায় বাঁধা নিয়মের বাইরে যাননা বলেই আম্মা মেহেরুন্নিসার যত ক্ষোভ।
নাশতাটা অনিচ্ছুক মুখে শেষ করেন। চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে মনটা একটু প্রসন্ন হলো। আজ ট্যালট্যালে দুধ চিনি ছাড়া চায়ের বদলে এককাপ ঘন দুধের সুঘ্রাণ ছড়ানো দারুন সুন্দর রঙ এর কাপ ভর্তি চা। চুকচুক করে চা খেতে খেতে মেহেরুন্নিসা ভাবেন মেয়েকে কী রাতের স্বপ্নের কথাটা বলবেন? শরীরটা কেমন যেন লাগছে থেকে থেকে। তার চেয়ে বুঝিবা মনটা। মেয়ে কী স্বপ্নের কথাটা বিশ্বাস করবে?
ও মিথি মা, একখান কথা কইতাম, শুইনবা নি?
মেহেরুন্নিসার কথায় আঞ্চলিকতা আর প্রমিতের একধরনের খিচুড়ি টানে পরিবারে সবাই অভ্যস্ত।প্রীতম, রাতুল।অরিন, জিহান,দিহান,এমনকী নাতবউ আনিলা সবসময় মজা করে,
পিছুলাগে নানী‘র, নানী শাশুড়ির।
কী আম্মা ? বলেন, শুনবোনা কেনো?
তোমার আব্বা,আর তোমার দাদাজান দোনোজনরে কাইল রাইতে স্বপ্নে দেইখসি।
ভালোতো। কী দেখলেন?
আমার নাতি নাতিনগো কইওনা, তারা হাসাহাসি কইরবো আমারে লই।দেইখলাম একদম আগের মতন। যেমন সইত্য সইত্য যেঁতা ভালা মানুষ । বাপ-পুত দোনোজন খানার পরে বইসছে বারিন্দার চেয়ারে। আমারে কয়,কই সেমাই পিঠা রাইনছো যে দেও। আমি আনি দিলাম ।একেবারে দুধ নারিকেল বাদাম দি রান্দইন্যা ঘন সেমাই পিঠা।
সুন্দর দেখলন আম্মা। ওই সেমাই পিঠা এক্ষুনি কী আর করতে পারবো? চালের গুঁড়ো নেই যে! আজ আপনাকে এগারোটার দিকে খুব জম্পেশ করে লাচ্ছা সেমাই করে দেবো।
আহা রে মিথি মা, সেমাই খাবার জইন্য না গো,তোমার আব্বা আর দাদা দুই জনরে একসাথে কেমনে স্বপ্নে দেইখলাম। তারা দুইজনে এত বাস্তব করি একসাথে বসি সেমাই খাইলো —-।
মেহেরুন্নিসা ‘কে আশ্চর্য বিষন্ন ও অন্যমনষ্ক দেখায়।চায়ের কাপে হাত লাগিয়ে দেখলেন আধখাওয়া চায়ের কাপে। ঠান্ডা হয়ে গেছে।আজ ঠান্ডা চা টুকু মেজাজ না করে একঢোকে
খেয়ে ফেললেন।তারপর মিথিলার সাহায্য ছাড়াই ধীরে ধীরে চেয়ার টেবিল দেয়াল ধরে ধরে পৌঁছে যান তাঁর কক্ষ লাগোয়া বারান্দায় । কোমর ব্যাথায় ককিয়ে উঠতে উঠতে বসে পড়েন প্লাস্টিকের ইজি চেয়ারটায়। শরিরটা কেমন যেন লাগছে।ঠিক ঘুম ও না,আবার সেইমতোই একটা অবশ মতো অবসাদ যেন ছড়িয়ে পড়ছে শিরায়, শিরায়। যেন রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে চোখজুড়ে। চোখ বন্ধ করার আগে দেখলেন জারুল গাছটা। তেতে ওঠা রোদের তেজটা আড়াল করে শান্ত স্থির নির্বাক অস্তিত্ব নিয়ে তাঁকেই যেন দেখছে।
মিথিলা রাহমান একবার উঁকি দিয়ে গেলেন – আম্মা, কিছু হয়েছে ? খারাপ লাগছে? শুইয়ে দিয়ে আসবো? চোখ মুদেই একহাত তুলে ইশারায় বোঝালেন লাগবেনা কিছু, কিছু হয়নি।
গ্যাসের চুলায় চিনি,এলাচ,দারচিনি দেয়া ফুটন্ত গরুর দুধের পাতিলে বড় চামচ ডুবিয়ে নাড়ছেন মিথিলা। আজ একটু ক্ষীরমতো করে সেমাইটা তৈরি করে আম্মাকে দেবেন।আর ভালো লাগেনা দিনরাত বুড়ো মানুষটাকে নিষেধের বেড়াজালে এতো এতো আটকাতে। কালরাতে তিনিও একটা স্বপ্ন দেখেছেন।তাঁর চোয়ালের দিকের দুটো দাঁত পড়ে গেছে। আজাদ সাহেব ,প্রীতম, রাতুল,অরিন,আনিলা তাঁর দুই মেয়ে জিহান,দিহান সবাই মিলে দেখছে দাঁত গুলো। মিথিলার কানের পিছনটা ব্যথা করে ওঠে। ছোটোবেলায় নানী বলতেন, স্বপ্নে চোয়ালের দাঁত পড়ে যেতে দেখলে মুরুব্বী মারা যায়। সারা শরীরটা কেঁপে ওঠে মিথিলার।সেমাইটা হয়ে গেছে। সেমাইয়ের পাতিলটা নামিয়ে রেখে গ্যাস বন্ধ করে দেন। আনিলা ডাকছে – টেবিলে আসুন মা, আমাদের নাশতা খাওয়াতো শেষ হলো বলে।
পাতলা চাপাতি রুটিতে খানিকটা সবজী নিয়ে রোল করে ছোট ছোট কামড়ে দ্রুত শেষ করেন।
কী ব্যাপার ? তোমার কী শরীর খারাপ ? আজাদ সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়েন মিথিলা ওষুধের বাক্স থেকে নিজের ওষুধ নিয়ে পানি দিয়ে গিলে নেন। তাঁর মুখায়বয়ব জুড়ে গাঢ় চিন্তার ছায়া। মিথিলার অজানা উদ্বেগ আজাদ সাহেবকেও ছুঁয়ে যায়। মেহেরুন্নিসার রুমের বারান্দার দিক থেকে অস্পষ্ট একটু গোংগানির আওয়াজ আসে। ক্ষীণ আওয়াজটা মিথিলাই শুনতে পান ।
কী হয়েছে ? আম্মা যেন—
বাক্যতা অসমাপ্ত রেখেই মিথিলা ছুটে যান দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে। পেছনে ছুটে যান আজাদ সাহেব,আনিলা,প্রীতম,বুয়া। মেহারুন্নিসার মাথাটা হেলে পড়েছে একপাশে। চোখ দুটো আধবোজা । ডানহাতের সার্বক্ষনিক সংগী ছোট তোয়ালেখানা মুঠো থেকে আলগা হয়ে নীচে পড়ে গেছে। মুখখানা হা করা, কষ বেয়ে খানিকটা লালা চুইয়ে পড়েছে ।
মিথিলার গলা চিরে বের হয়ে আর্তনাদ- প্রীতম, আনিলা …আম্মা,আমার আম্মা –ও আল্লাহ –
আজাদ রহমান বিড়বিড় করে কালেমা পড়তে থাকেন। প্রীতম মোবাইলে ব্যকুল ভীত গলায় এয়ম্বুলেন্স সার্ভিসে ফোন করে যাচ্ছে ,আনিলা করছে ডাক্তারকে। মিথিলা রহমানের চোখে অশ্রুধারায় ভিজে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে রাতে স্বপ্নে দেখা দুটো সদ্য পড়ে যাওয়া চোয়ালের দাঁত ।
১ Comment
congratulations