১৫৬ বার পড়া হয়েছে
একটি গভীর রাত
মুহাম্মদ কামাল হোসেন (কুড়ি)
নিয়ম মেনে চলতে চলতে হঠাৎ মনে থাকে না নিয়মের কথা। গভীর রাত দুচোখ স্বপ্ন আঁকে স্মৃতিকথা মনে ভাবতে ভাবতে ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে বন্ধু মাইদুল জেগে ওঠে। “এই তোর কী হইছে? এত শব্দ করছিস কেন? যা শালা নিশাচর, ঘরে জেগে থাকার চেয়ে বাহিরে ঘোর।” নিজেকে সামলাতে কথা বাড়ালাম না। আস্তে করে দরজাটা খুলে বাহির হলাম খালি হাত পায়ে। মাইদুল বলল, “কোথায় যাস এত রাতে..নাটক!” আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বাহিরে দু’পা ফেলতেই বারান্দার টিনের চাল ফেটে কী যেন পালালো! একটু ভয় পেলেও বুঝলাম ইঁদুরের পিছে বিড়ালের দৌড়। একটি কালো বিড়াল সকাল-দুপুরে গা এলিয়ে ঘুমতে দেখি। আর মনে মনে ভাবতাম এই বিড়ালের কী আরাম চার হাত-পা মেলে সুখের ঘুম দিয়েছে। খাওয়া দাওয়ার কোন তাগাদা নেই। শুধু ঘুম আর ঘুম কিন্তু আজ রাতে সেই ঘোর কাটলো। টিনের চাল ফাটা শব্দে।
বিশাল বড় ছাত্রাবাস। চারপাশ ঘিরে ইটের দেয়াল ও টিনের ছাওনিতে ছোট ছোট কক্ষে অনেক ছাত্রদের আবাসস্থল। ভিতরে চারপাশে বারান্দা ঘেষে পেয়ারা ও আম গাছ, মাঝে ফাঁকা। সেই ফাকা স্থানে বিকালে প্রতিযোগিতা করে ক্রিকেট খেলে ঘাম বের করি।যেটা বলছিলাম-ছাত্রাবাসের দরজা খুলতেই কুকুরের মত কয়েকটা জন্তু দৌড়ে গিয়ে একটু সামনে দাড়ালো। ভয় পেয়ে আমিও দাঁড়ালাম। অন্ধকারে দেখা যায় না তবে বুঝা যায় ওগুলো শিয়াল। হাতে মোবাইলটা নেই যে আলো জ্বেলে দেখবো। মোবাইলটা ইচ্ছা করে নেইনি কারণ মাইদুল ফোন দিতে পারে। তাছাড়া মাইদুল যাতে বাহির হতে না পারে সেজন্য বাহিরের ছিটকিনি লাগিয়ে এসেছি। ইচ্ছে মন খুলে জনশূন্য কোলাহল মুক্ত গভীর রাতে একটু ঘুরে দেখা। শিয়ালগুলো যেন বলছিল, ‘আয় দেখি কত বড় সাহস!’ আমার যেন সম্মানে লাগালো। হাতরে একটি লাঠি খুঁজে এমনিতেই ঘন শব্দ দৌড়ে ভয় দেখালাম। শিয়ালগুলো দৌড়ে পালালো।
আমি লাঠি খানা পুঁজি করে সামনের দিকে যেতে লাগলাম। ঝিঁঝি পোকার ডাক কানে তালা লাগালো। ছাত্রাবাসের চারপাশ ফাঁকা বললেই চলে। তাতে জমি মালিক ধান চাষ করেছে। ধানে মুঞ্জরিছে তার একটা ঘ্রাণ বিমোহিত করে তুললো। চতুর্দিকে কুকুরের ডাকাডাকি শুরু হলো কারণ খুঁজতেই অনেকগুলো শিয়াল হুক্কাহুয়া ডেকে উঠলো। আমি সুরু পাকা রাস্তায় কুকুরের চিৎকারে থমকে দাড়িয়েছি। শিয়াল ও কুকুরের চিৎকার থেমে গেলে আবার পথ চলা শুরু করলাম। রাস্তা ঘেঁষে বিদ্যুতের একটি খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে ব্যাঙ,ঝিঁঝি পোকাসহ অজানা নানা পোকামাকড়ের শব্দে অবাক হচ্ছিলাম। কারণ দিনে মানুষের কোলাহলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়! এসব তুলনা না করতেই ওয়াব..ওয়াব বলে মেছো বিড়াল আমার দিকেই আসছিল। ভয় লাগলেও অতি সাহস নিয়ে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে মূর্তির ন্যায় মিশে রইলাম। কাছে আসতেই ধানের শীষের মুঞ্জরীর সুঘ্রাণ ম্লান হয়ে গেল মেছো বিড়ালের গন্ধে।
ধীরগতিতে মেছো বিড়ালটি দূরে চলে গেল। আমি নির্বিকার চিত্তে আবছা আবছা দেখলাম। হঠাৎ অদূরে পাশের বাড়িতে চিল্লাচিল্লি, কান খাঁড়া করে আছি, দেখছি কে যেন দৌড়ে আসছে! কাছে আসতেই সাহস করে জোরে সোরে বললাম -কে? লোকটি গতি থামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে লাঠিটি ঠিকমতো হাতে আঁটলাম। নিকটে এসেই ফিসফিসিয়ে বললো ভাই, আপনার পায়ে ধরছি আমারে বাঁচান! আরে লিটন যে, কোত্থেকে তুমি? ভাই বলার সময় নাই, চলেন ছাত্রাবাস যাই। কালকে বলবো সব খুলে। আমার চেয়ে শতগুণ দক্ষতার সাথে পা চুপিচুপি ফেলে, আমার হাত ধরে ছাত্রাবাসের দরজা খুলতেই দেখি ছাত্রাবাস আলোকময়!
দুজন চোরের মত ভিতরে ঢুকতেই দেখি মাইদুলসহ কয়েকজন বারান্দায় লাইটের আলোয় বসে আছে চোরের অপেক্ষায়। বুঝতে পারলাম আমার ভুলেই এই অবস্থা! কেন ছিটকিনিটা দিয়েছি। মাইদুল বললো -“ঐ শালা,কৈ গেছিলি?” আমি তো কিম্ভূতকিমাকার! লিটন,আমার উত্তর স্বহাস্যে বললো, “না ভাই কোথাও না,শিয়াল ধাওয়া করতে,শুনতে পাচ্ছেন কত শোরগোল শোনা যাচ্ছে। বলেই- আমার দিকে তাকিয়ে বললো,আহা রে পালওয়ান ভাই! শিয়ালকে একটা পিটনিও দিতে পারলেন না।” আমার হাতে লাঠিটা,তখনও হাতেই রয়েছে। মাইদুল ক্ষিপ্র গতিতে এসে লাঠিটা নিয়ে একটা পিটন হাঁকিয়ে বললো,”শালা তুই বাহিরে যাবি যা, তো ঘরের ছিটকানি দিলি কেন? আবার মোবাইলটা নিসনি কেন? আমি তো ভয় পেয়ে গেছি!”লিটন রাগ দেখিয়ে লাঠিটা অদূরে ঢেল দিয়ে ফেলে আমার হাত ঝটকানি দিয়ে ঘরে নিয়ে গেল। কানের কাছে আস্তে-ধীরে বললো, “ভাই পায়ে ধরছি কিছু বলবেন না। ঘুম আসেন, কালকে দেখবো পালাওয়ানকে। আমি লিটন যদি এক বাপের সন্তান হয়ে থাকি! হুম।”গভীর রাতে ছাত্রাবাসে ঘুম ভেঙে যাঁরা উঠেছিল তারা সবাই বেকুবের মত তাজ্জব হয়ে যাঁর যাঁর ঘরে চলে গেল।
আমি অবাক,কী হচ্ছে? চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ভাবছি। মাইদুল ঘরে এসেই আমার দুই পা জড়িয়েই, “বন্ধু তুই আমারে বাঁচা,লিটন কালকে আমারে ছাড়বো না। আমি হাসি দিয়ে বললাম, যা ঘুম আসেক। আমি শব্দহীন ঘুমের পথে, ওদিকে মাইদুল এপাশ-ওপাশ করছে। আমি বুঝতে পেরে বললাম, দুলাভাই একটু ঘুম আসেন! বাকী রাতটুকু আমার ঘুম হলো না! সকাল হতে না হতেই মহল্লার একদল লোক ছাত্রাবাসে এসে জানতে চাইলো যে,আমরা কোন লোককে গতরাতে দৌড়াতে দেখেছি কীনা?অথবা ছাত্রাবাস থেকে কেউ গতরাতে বাহিরে গিয়েছিল কীনা? লিটনসহ সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সবাই সবার মুখ পানে তাকিয়ে না তো, না তো বলল। আব্দুল আলীম সহজ সরল ছেলে সে কোন মার প্যাচ না বুঝেই মহল্লার লোকদের জিজ্ঞেস করে বলল,কী হইছে বলা যাবে? না! হেরে পাইলেই কমু!একজন মুখ ফসকে বলেই ফেললো ইজ্জত শেষ গো! শেষ! সবাই চলে গেল। আব্দুল আলীম বলল,নিশ্চয় নারী ঘটিত কোন ঘটনা হবে। লিটন ধমক দিয়ে বলল, বেশী পাকনা হয়ে গেছ! কার কী হইছে জেনে লাভ নেই। যে উদ্দেশ্যে এখানে আসছি সেটার প্রতি খেয়াল রাখ? আমাদের এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন নেই।
সবাই যার যার মত বিচ্ছিন্ন হলে লিটন তার রুমে আমাকে ডাকে। ভাই আমি যে সেই দৌড়ানো ব্যক্তি এটা কাউকে বলবেন না! তাছাড়া আপনি আর আমি একসাথেই গভীর রাতে ছাত্রাবাসে ঢুকেছি। লিটনের রুম থেকে এসে পরদিন রাতে আমি ভাবছি হায় আল্লাহ মাত্র কয়েক ঘন্টা নিশাচর প্রাণী হতে গিয়ে যে জালে আবদ্ধ হলাম! সত্যি বিচিত্র মানুষের বিচিত্র রূপ দেখে কে ? কী করে? কীভাবে মত পাল্টায়! ঘরের চালে কাট পোকা অনবরত কটকট করৎ করে কাট কেটেই চলছে। অন্ধকারে পুরোটা ঠাওর করতে না পারলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না; বন্ধু মাইদুলও ঘুম আসেনি! কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে! ভয়, লিটন মাইন্ড করেছে। কীভাবে সমঝোতায় আশা যায় এই চিন্তায়! আমি শপথ করছি মনেমনে,নিশাচর প্রাণীর স্বভাব জানতে, যাবো না একাকী অতি দূরে…! হতভম্ব ঠাওর করতে পারছি না একটি গভীর রাতের স্মৃতি ভেবে….!