চর্যাপদ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রাচীন কাব্যিকরূপ
সৈয়দা রুখসানা জামান শানু
‘চর্যা’ অর্থ আচরণ বা অনুশীলন, এই ‘চর্যা’ থেকেই ‘চর্চা’ শব্দটির উদ্ভব। অর্থাৎ বলা যায় মানুষের দৈনিন্দন জীবন রীতি নীতি এবং আচরণের একটি বহি:প্রকাশ কবিতায় বা শ্লোকের মাধ্যমে। আর এটি প্রাচীন ইতিহাসের একটি নিদর্শন। বলা যেতে পারে ভাষার আদি পিতা-মাতা।হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা প্রসিদ্ধাচার্যদের অনেকেই ছিলেন বাংলার অধিবাসী। শবরপা, কুক্কুরিপা ও ভুসুকুপা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। যে সকল ভাষা তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যচর্যার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককে প্রমাণ করে চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি-না সে বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীকালে যার অবসান হয়েছে। এটি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপরিণত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ।
চর্যাপদ রচনার সময়কাল নিয়েও ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, চর্যাপদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলেই অনুমান করা হয়। কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা নামে এক বৌদ্ধতান্ত্রিক পুঁথির সন্ধান মেলে, যেটির রচনাকাল শেষ পালরাজা গোবিন্দপালের শাসনকাল সময়কে বোঝায়। বাংলায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ব্রাক্ষ্মণ হিন্দু সমাজের পীড়নের আশঙ্কায় বাংলার বৌদ্ধগণ তাঁদের ধর্মীয় পুঁথিপত্র নিয়ে এবং শীর্ষদের সঙ্গী করে নেপাল, ভূটান, তিব্বতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। চর্যাপদের রচনাকাল যে শতাব্দি হোক না কেনো এর ভাষা নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতামত।
এই ধারণা থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিনবার নেপাল পরিভ্রমণ করেন। ১৮৯৭ সালে বৌদ্ধ লোকাচার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি প্রথমবার নেপাল ভ্রমণ করেন। ১৮৯৮ সালের তাঁর দ্বিতীয়বার নেপাল ভ্রমণের সময় তিনি কিছু বৌদ্ধ ধর্মীয় পুঁথিপত্র সংগ্রহ করেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বার নেপাল ভ্রমণকালে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নামক একটি পুঁথি নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন।
চর্যাপদের ভাষা নিয়ে যে মতবিরোধ রয়েছে তার প্রধান কারণ হলো সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই ছিলেন বাংলার অধিবাসী। আবার বিভিন্ন পন্ডিতদের মতে, চর্যাপদের ভাষার সাথে, ‘অসমিয়া’, ‘ওড়িয়া’,’বাংলা’ ও ‘মৈথিলী’ ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা ইতিহাস বলে চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত উপমা ও রূপকল্পগুলি তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন, পরিবারজীবন ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগৃহীত এবং তৎকালীন ভৌগলিক সীমানাও ছিল পূর্ব-পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অসম, ঝাড়খান্ডসহ পূর্ব ও উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত। কিন্তু আমার দৃষ্টি হচ্ছে সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই ছিলেন পূর্ব বাংলার অধিবাসী। সে কারণে চর্যাপদে যে শোøাক বা বল,চর্যাগীত, চর্যাপ্রবাদ পাওয়া যায় তার অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাংলার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়।
চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীনকাল হতে সমুদ্রপথে নিরাপদ যাতায়াত উপযোগিতার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল ছিল চট্টগ্রাম। আদিকাল হতেই চট্টগ্রাম প্রসিদ্ধ। বৌদ্ধপন্ডিতগণ যেখান থেকে চট্টগ্রামে বিহারে আসুক না কেনো, সাহিত্যচর্চায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে আদর্শ হিসেবে বেছে নেন। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবের প্রারম্ভ হতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। চর্যাপদের ভাষা, শব্দগঠন, না-বোধক শব্দের অবস্থান, উৎপত্তিগত ইতিহাস, রচয়িতাদের ধর্ম, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আধুনিক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও চাটগাঁইয়া ভাষার সাহিত্যকর্ম, আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চা প্রভৃতি বিশ্লেষন করলে বিনা দ্বীধায় বলা যায়, চট্টগ্রামে চর্যাপদ রচিত হয়েছে এবং চর্যাপদের রচয়িতাগণের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। অধিকন্তু তাঁরা যে দোহা বা চর্যাপদ নামের কাব্য সৃষ্টি করেছেন তা চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষা অনুসরণে রচিত। আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যকর্ম করলে তা সহজে সাধারণ জনমনে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হতো। এ জন্য চর্যাকারগণ মূলত চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যকর্ম রচনা করতেন। যার প্রভাব এখনও আরকান, বার্মিজ ভাষা, নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন বঙ্গসংলগ্ন রাজ্যে লক্ষণীয়।
চট্টগ্রামে বসে এসব চর্যা বা দোহাগাণ রচিত হয়েছে বলে চর্যাপদের বাক্যের গঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। এই প্রভাব থেকে স্পষ্ঠভাবে লক্ষ্যণীয় চর্যাপদ লেখা হয়েছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতে। শুধু এই চর্যাপদ নয়, অধিকাংশ চর্যার বাক্যগঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গঠনশৈলী, অর্থ ও পরিবেশ-পরিক্রমা লক্ষণীয়।
চট্টগ্রামের লোকগান কত প্রাচীন তা যথার্থভাবে নির্ণয় করা কঠিন হলেও আধুনিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, চট্টগ্রামের লোকগান চর্যাপদের সমসাময়িক। অনেকের মতে, চর্যাপদের পূর্ব থেকে চট্টগ্রামের লোকগানের উৎপত্তি। পাহাড় নদীর সংগম আর নিজস্ব ভূনের স্বকীয়তা চট্টগ্রামবাসীকে বহুপ্রাচীনকাল থেকে লোকগানের প্রতি প্রকৃতিগতভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছিল। তাই চট্টগ্রামের লোকগানের ভাষা, অক্ষর ও বিন্যাসের সঙ্গে বাংলার আদি নিদর্শন চর্যাপদের চমৎকার সাদৃশ্য ও মিল দেখা যায়। কেননা চর্যার পদকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের। তবে তারা চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা বা জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের নাকি চট্টগ্রামে আগমন করেন বা অস্থায়ী বসবাস করতেন বা ধর্ম সাধনা করতেন, সে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, আলোচ্য বিষয় তাদের গীতিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মিল রয়েছে।
চর্যাপদ এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গঠন ও অর্থগত নিবিড়তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চর্যাপদ মূলত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটি প্রাচীন কাব্যিক রূপ। যারা চর্যাপদ লিখেছেন তারা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী। এরূপ লোকদের অধিকাংশের নিবাস ছিল চট্টগ্রাম। তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নির্দশন হলেও এ আদি নিদর্শন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মৌলিকতায় সমর্পিত একটি মনোহরী ভাষা।
চর্যাপদের ভাষা কি? প্রবন্ধ কিছুটা ইঙ্গিত জোগাবে যে, চর্যাপদকে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত, যদি আমরা এ প্রবন্ধের আলোকে দেখি যে, চর্যাপদের অনেকগুলো শব্দ এখনো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বুলি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পদকর্তারা চর্যাগীতির মাঝে বা শেষে যে ভণিতা দিয়েছেন, সে হিসাব করলে চব্বিশজন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। এরা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ। চৌরাশি সিদ্ধার অন্তর্গত। এদের মধ্যে লুই, কুক্কুরী, ডোম্বী, কবর, ধাম, জপনন্দি এরা সবাই নিঃসন্দেহে বাঙালি।এ ছাড়া শুধু ভাষা বিচার করলে আরো কয়েকজনকে বাঙালি ধরে নেয়া যায়। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. সুকুমার সেনও দাবি করেছেন চর্যাপদ বাংলারই প্রাচীন ভাষা। এটাও বলা যায়, চট্টগ্রামী উপভাষার পরিপ্রেক্ষিতে চর্যাপদ।
চর্যাপদের সমাজচিত্রতেও দেখি নদী, অরণ্য, পাহাড়, টিলা, সমুদ্র প্রভৃতির বর্ণনা, এর সব কিছুই আমরা দেখতে পাই বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রকৃতিতে। চর্যায় আছে হরিণ শিকারের কথা। বন্য হাতির কথা। চোলাই মদের প্রসঙ্গ। আছে নৌকা, পাড়, সাঁকো ঘাট প্রভৃতির কথা। এছাড়াও ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের একটি শেষ আশ্রয় হ’ল চট্টলা। পদকর্তাদের কেউ কেউ যে চট্টগ্রামের তার স্বপক্ষে এটাও বলা যায় যে, নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম ছিল বৌদ্ধধর্ম চর্চার অন্যতম স্থান। শুধু তাই নয় বন্দর চট্টগ্রামে বণিক আর ধর্মপ্রচারক পীর সুফিগণ যেমন সহজে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তেমনি বৌদ্ধরাও। শঙ্করাচার্যের প্রভাবে ভারতের উড়িষ্যা এবং অন্যান্য স্থানে বৌদ্ধরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন নেপালের মতো চট্টগ্রামও হলো তাদের আশ্রয়স্থল।
আগামী প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে চর্যাপদ রচয়িতাগণের নাম। তাঁরা হলেন: লুই, ক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডেম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কন, জয়নন্দী, ধাম, তান্তী পা এবং লাড়ীডোম্বী।
চট্টগ্রামে এখনো রয়েছে বৌদ্ধদের অসংখ্য কেয়াঙ। বাংলাদেশে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বেশি লোক এখনো বসবাস করে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের ভাষার বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন শব্দ ও বৌদ্ধসাধকদের আশ্রয় প্রমাণ করে যে, চর্যার পদকর্তাগণের কেউ কেউ চট্টগ্রামবাসী ছিলেন। শুধু তাই নয়,চর্যাপদ রচনার সময়ে এই ভাষাগুলো ছিল একই পরিবারের সদস্য। আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাও ছিল তখন সে একই পরিবারের সদস্য। যে যুক্তিতে ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’র ভাষাকে অসমীয়া ভাষা বলে দাবি করা যায়, সে যুক্তিতে চর্যাপদের ভাষার ওপর চট্টগ্রামের ভাষার দাবি মেনে নিতে হয়। পরিশেষে বলব, চর্যাপদ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রাচীন কাব্যিক রূপ বলেই চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ, ইতিহাসের উৎস এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির, সাহিত্যরস আস্বাদনের অনন্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সম্পাদক-প্রকাশক, গবেষক ও কবি
তথ্যসূত্র: বাংলা উইকিপিডিয়া,
৩ Comments
ঋদ্ধ হোলাম…ভালোবাসা রইলো শানু ।
ড আমিনের লেখাকে হুবহু কপি করে নিজের নামে চালানো হয়েছে।
really???