১,৮৪৩ বার পড়া হয়েছে
গল্প
ঝরাফুল
আফছানা খানম অথৈ
বীথি ম্যাট্টিক পরীক্ষার্থি। দেখতে শুনতে মন্দ না। হালকা পাতলা, সিমচাম বডি মায়াবী চেহারা,সুশ্রী গড়ন। কিন্তু মায়াবী চেহারায় কেন জানি মলিন চাপ। পড়া লেখা খাওয়া দাওয়া কোন কিছু ঠিক মতো করতে পারছে না। সব সময় কেন জানি মনমরা হয়ে বসে থাকে।তবুও সে লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সন্ধ্যা সাতটা সে সবেমাত্র পড়ার টেবিলে বসলো। বই খুলে চোখ বুলাতে,একি অবস্থা তার চোখ দুটো ঝাপসা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা সমস্ত শরীরে জ্বালা পোড়া। ঘরের গন্ডীবদ্ধ সীমানায় মনে হয় দমবন্ধ হয়ে আসছে। ভাবল গায়ে একটু বাতাস লাগলে ভালো লাগবে। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে বাগান বাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো। অমনি ঝিরঝির বাতাস বইতে লাগল।
ক্ষনিক মুহুর্তের জন্য ভালো লাগলে ও পরক্ষণে আবার অস্থিরতা শুরু হলো।
আর বসে থাকতে পারলো না। তাড়াহুড়া করে ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তখনি ডাক দিলো,
মা আমার কেমন জানি লাগছে।
মা ছুটে এসে দেখে বীথি বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। তিনি তখনি আওয়াজ তুলেন।
বীথি বীথি কি হয়েছে, কথা বলছিস না কেন?
বীথি আর কিছুই বলতে পারলো না, জ্ঞান হারালো ।বীথি কেন জ্ঞান হারালো তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু…।
কিছুক্ষণ পর বীথির দাদি মা বলে, বীথির গায়ে আগলা ছোঁড় লাগছে। ঝাড় ফুঁক দেওন লাগব।
আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করে এখন ও মান্ধাত্বা আমলের কথায় বিশ্বাসী তাই বীথির দাদির কথাকে সঠিক মনে করে তার বাবা ছুটে গেল গুনিন ডাকতে। গুনিন বীথিকে দেখে বলে,
বড় খারাপ জ্বিন, তাই বেহুশ কইরা পালাইছে। ঝাড় ফুক দেওন লাগব।
তিনি বিড়বিড় করে কি সব পড়ে বীথির গায়ে ক’য়েক বার ফুঁ’দিলেন। অতঃপর একটা তাবিজ দিয়ে বলেলন ‘
চিন্তা কইরেন না ভালো অইয়া যাইব।
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে বীথির জ্ঞান ফিরে আসল। মা-বাবা সহ সবাই খুশি। তারা মনে করল গুনিনের ঝাড় ফুঁকে বীথির জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাই বলল,
বীথি তাবিজটা ভালো করে হাতে বেঁধে দে, তা না হলে ওরা আবার তোকে বেহুশ করে ফেলবে।
বীথির এখনও তেমন বুদ্ধি জ্ঞান হয়ে উঠেনি। তাই মুরব্বীদের দেয়া পরামর্শকে ভালো মনে করে যত্ন সহকারে তাবিজটা হাতে বেঁধে নিলো। ইতিমধ্যে পাশের বাড়ির বখাটে ছেলে মিঠু তাকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। শুধু তাই নয় বিয়ের প্রস্তাব ও পাঠিয়েছে। বীথির বাবা না করে দিয়েছে। সে এতে ক্ষেপে উঠে কড়া ধমক দেয়,
আমার সঙ্গে বিয়ে না দিলে, আমি জানে মেরে ফেলব ।
ভয়ে থত্থর সবাই। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছেনা ।
শেষে ভাবনার অবসান হলো। সবাই বীথিকে না পড়ানোর পক্ষে সাপোর্ট করলো। তাদের ধারণা বীথি স্কুলে না গেলে মিঠু তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু না বখাটেরা সব সময় মেয়েদের ডিস্টার্ব দেয়।কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। এই প্রবাদকে সঠিক মনে করে বীথি রীতি মতো স্কুলে যাতায়াত ও পড়া লেখা চালিয়ে যাচ্ছে।সামনে পরীক্ষা পড়ার খুব চাপ। রাত বারোটা, বীথি এখনও পড়ার টেবিলে। পাশের ঘর থেকে মা আওয়াজ তুলল,
বীথি এত রাত জেগে পড়তে নেই। শরীর খারাপ করবে, শুয়ে পড়।
মায়ের সংকেত পাওয়া মাত্রই সে শুতে গেল। চৌকিতে সবেমাত্র বসলো। পা দুটো এখন ও নিচে পড়ে আছে।আড়মোড় খেয়ে পা দুটো তুলে নিলো। এমতাবস্থায় তার মাথা টনটন, চোখ দুটো ঝাপসা,শরীর জিনজিন,মুখ বন্ধ হয়ে আসছে, কথা বলতে পারছে না। তবুও বহু কষ্টে আওয়াজ তুলল,
“মা…..মা….. আ…..মা….র….কে….ম….. ন….জা….নি….লা…..।
আর কিছুই বলতে পারলো না। বিছানায় পড়ে গেল। মা-বাবা এখনও ঘুমাননি। তাই মেয়ের কণ্ঠ শুনা মাত্রই ছুটে এলেন, এসে, একি দেখল, মেয়ের কোন সাড়া শব্দ নেই। চুপচাপ শুয়ে আছে। বীথি বীথি বলে উনারা কয়েক বার ডাক দিলো, তাতেও কোন সাড়া শব্দ নেই।
তারা বুঝতে পারলো বীথি আবারও জ্ঞান হারিয়েছে। মা-বাবা দুজনে ফুস ফুস করে বলে,
বখাটে মিঠু বীথির জন্য তাবিজ, কবজ, বানটোনা করেছে। তাই বীথি আবার ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
মা বলল, আর দেরী করা যাবে না।তাড়াতাড়ি গুনিন ডাকতে যান। বাবা তাতে সম্মতি দিলো। এবং দ্রুত গতিতে ছুটে গেল গুনিনের বাড়িতে। আগের গুনিন ভালো না, তাই নতুন গুনিন নিয়ে আসল। গুনিন বীথিকে দেখে বলে,
আপনারা বড় দেরি কইরা পালাইছেন, বহুত কঠিন বেরাম, বানটোনা করেছে মরনের লাইগ্যা। কাটা চিড়া করতে অইব।
মরনের কথা শুণে মা-বাবার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না। উনারা কেঁদে কেঁদে বলে,
গুনিন সাব যেমন করে হোক আমার মেয়েরে ভালো করে দেন।
গুনিন মাথা নেড়ে সাঁয় দিলো,
হুম করমু।
গুনিন রোগীর পাশে গিয়ে বসলো। ভালো করে দেখে নিলো।তারপর কিভাবে ধোকা দেয়া যায় ভাবনা চিন্তা মগ্ন।
শেষে একটা কুবুদ্ধি মাথায় আসলে তিনি কাজ শুরু করলেন। প্রথমে একটা কাচি হাতে নিলেন। তারপর ঠোঁট দুটো নেড়ে চেড়ে বিড়বিড় করে কি সব পড়ে মাটিতে রেখা টেনে একটা চতুর্ভূজ আঁকলেন। শুধু চতুর্ভূজে তো সব সমস্যার সমাধান হবে না।তাই কি মনে করে ভিতরে কিছু আঁকা বাঁকা রেখা টেনে দিলেন। তারপর তেল পড়া, পানি পড়া,তাবিজ বীথির বাবার হাতে দিয়ে বলল,
আর কোন চিন্তা নাই। সব কাইট্যা দিছি। বানটোনা বলে কথা। তাই খুব কষ্ট অইছে। দেখতাছেন না আমার শরীর ঘামে ভিজে জবজবে। তবে আর একটা কথা আমার দেয়া জিনিস গুলা ভালো ভাবে ব্যবহার করতে কইবেন।
এই সব কথা বলে তিনি তার সেলামি নিয়ে বিদায় হলেন। পরক্ষণে বীথির মা তাবিজটা বাঁম হাতে বেঁধে দিলো, আর তেল পড়া, পানি পড়া হাতে মুখে ছিটে ও মালিশ করে দিয়ে মেয়ের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় বসে রইল। প্রায় ঘন্টা দু’য়েক পরে বীথির জ্ঞান ফিরে আসল। মা এগিয়ে এসে বলে,
কিরে মা তোর কেমন লাগছে, কথা বলছিস না কেন?
বীথি চুপ চাপ, কিছুই বলছে না, মায়ের মুখ পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
পরক্ষণে বলে উঠল,
মা আমি কোথায়?
জবাব দিলো মা,
কেন তোর ঘরে। সে আর কিছুই বলল না। চুপসে গেল। মা বুঝতে পারলো মেয়ে খুব ক্লান্ত তাই বলে উঠল,
বীথি আর কোন কথা নয়, ঘুমিয়ে পড়। বীথিকে ঘুম পাড়িয়ে তারা দুজনে আলোচনায় বসলো। তারপর বীথির মা বলল,
ওগো বীথির তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও। তা না হলে মিঠু আবার বানটোনা করবে।
বাবা সাঁয় দিয়ে বলল,
আমি ও তাই ভাবছি।
পাত্র দেখা দেখি শুরু…।
এর ফাঁকে মাস খানেক কেটে গেল। বীথির পরীক্ষা শুরু হলো।পাঁচ বিষয় শেষ। আজ বুধবার অংক পরীক্ষা। বীথি মনোযোগ দিয়ে অংক করছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পার হলো। তার হাত আর চলছে না, অসাড় হয়ে আসছে।হাত থেকে কলম টেবিলের উপর ধড়স করে পড়ে গেল। হলের দায়িত্বে থাকা টিচার দৃশ্যটি দেখে এগিয়ে আসল। ততক্ষণে বীথি টেবিলের উপর মাথা রেখে কাত হয়ে পড়ে গেল। তখনি টিচার জিজ্ঞেস করলো,
এই মেয়ে তোমার কি হয়েছে, এমন করছ কেন?
তার কোন জবাব নেই। বীথি চুপচাপ, কথা বলতে পারছে না। টিচার বুঝতে পারলো তার জটিল কোন সমস্যা। তাই আরলি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে খবর পাঠালো। তিনি দ্রুত গতিতে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। স্টুডেন্ট বলে কথা, তাই অভিজ্ঞ ডাক্তার গন ছুটে আসলেন ইমারজেন্সি কক্ষে। রোগিকে ভালো করে দেখলেন।তারপর দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,
রোগির অবস্থা ভালো না, খুব সিরিয়াস। আরলি তাকে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যান।
এতদিন পরে অবিভাবকের টনক নড়ল। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা করলো। বরাবর রাত দশটা, তারা একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে পৌছল। ইমারজেন্সি কক্ষে রোগিকে রেখে নার্স ডাক্তার কল করলো। তারা দ্রুত গতিতে ছুটে আসল। রোগীকে ভালো করে দেখে নিলেন।তারপর কিছু পরীক্ষা লিখে দিয়ে বীথির বাবাকে বললেন,
এই পরীক্ষা গুলো করে নিয়ে আসেন। তারপর বুঝব রোগীর কি সমস্যা। আমি নার্সকে বলে দিচ্ছি স্যালাইন পুস করার জন্য।
এইসব পরামর্শ দিয়ে তিনি চলে গেলেন। বীথির বাবা গেলেন পরীক্ষা কক্ষে।টাকা পয়সা ফ্রেমেন্ট করে তিনি বসে রইলেন রিপোর্ট’র জন্য।অনেক্ষণ পরে কাগজ পত্র হাতে আসতে তিনি ছুটে গেলেন ডাক্তারের কাছে।রিপোর্ট’র কাগজ পত্র হাতে আসতে ডাক্তার একি দেখলেন!রোগীর ব্রেন টিউমার তাও একেবারে শেষ পর্যায়ে মৃত্যু অনিবার্য সত্য।কথাটা ভাবতেই ডাক্তারের সুন্দর চেহারায় মলিন চাপ পড়ে গেল। তিনি চুপসে রইলেন। তখনি বীথির বাবা জানতে চাইল, ডাক্তার সাহেব কথা বলছেন না কেন, আমার মেয়ের কি হয়েছে?
সত্য কোন দিন চাপা থাকেনা। ডাক্তার করুণ কণ্ঠে জবাব দিলো,
আপনার মেয়ের ব্রেন টিউমার তাও শেষ পর্যায়ে।
বাবা কেঁদে কেঁদে বলে,
কি সব অলক্ষণে কথা ডাক্তার সাহেব,আমার মেয়ে বাঁচবে না, তার চিকিৎসা হবে না।
ডাক্তার মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো,
না বাঁচবে না।
মরার কথা শুনে তার ভিতরের আকাশে কান্নার জোয়ার…।
চোখের জল পড়ছে অনবরত। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আঁশ। এই প্রবাদের সুত্র ধরে রোগী বাঁঁচবে না জেনেও ডাক্তার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্লুকোজ স্যালাইন সহ কিছু মেডিসিন তার শরীরে প্রয়োগ করলেন। দু’দিন দু’রাত অজ্ঞান অবস্থায় থাকার পর তৃতীয় দিনে চোখ মেলে সবার দিকে তাকাল।কিছু একটা বলতে চাইলে,
বাবা এগিয়ে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, বীথি মা কিছু বলবি?
মেয়ের চোখের জল পড়ছে অনবরত। কথা বলতে পারছে না। তবু ও বহু কষ্টে বলে,
বা…বা….আ…মা….কে….মা…..ফ….ক…।
সে আর কিছুই বলতে পারলো না। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করলো। এমনি অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে বীথির মত একজন কিশোরী “ঝরাফুলের” মতো ঝরে পড়লো এ সুন্দরতম জগৎ থেকে।
১ Comment
ভালো লাগলো