খাবারের অপচয় ভদ্রতা নাকি ফ্যাশন
আবুল খায়ের
আমাদের দেশে কী গ্রাম কি শহর। এমন কিছু আচার-অনুষ্ঠান এখনও প্রচলিত আছে। যে অনুষ্ঠান গুলোর বড় আর্কষণ হলো পর্যাপ্ত (Reach Food) খাবার পরিবেশন। আইটেমও থাকে অনেক রকমের। বনভোজন, বিয়ের অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বৌভাত/বধুবরণ, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, আকিকা/নাম রাখা, মিলাদ মাহফিল, কুলখানি, সুন্নতে খৎনা, চল্লিশা, মেজবানী উৎসব, দাওয়াত, ওয়ার্কশপ/সেমিনার, রাজনৈতিক সভা, বার্ষিক সাধারণ সভা/সমিতি ইত্যাদি। বাড়িতে কিংবা কমিউনিটি সেন্টার অথবা হোটেলে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় হয়। টেবিলে প্রচুর খাবার দেয়া থাকে। খাবারের প্লেটেও অনেক রকমের খাবার দেয়া থাকে। ছোট-বড় সবার জন্য একই প্লেট। এক প্লেটের খাবারই হয়ত দু’তিনজন খেতে পারবে না। তাতে কোন অসুবিধা নেই। প্লেটে কিছু খাবার রেখে দিতে হবে। এটা ভদ্রতা(!)। সব খাবার খেয়ে প্লেট খালি করলে মানুষ অভদ্র ভাব’বে(?)। অনেকেই চার ভাগের এক ভাগও না খেয়ে হাত ধুয়ে নেন। অথচ খাবারের আশায় ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়-আশে পাশে অনেক টোকাই/গরিব ছেলে-মেয়েদের। অনেকে মারধর এমনকি অপমানও সহ্য করে। তথাপি অপেক্ষা করতে থাকে, প্লেটের ঝুটা/উচ্ছিষ্ট খাবারটাও যদি পাওয়া যায়। বড় অনুষ্ঠানগুলিতে মেহমানরা খাবার খেয়ে বের হতে না হতেই এক শ্রেণীর টোকাই/গরিব ছেলে-মেয়েরা (পুরাতন/নোংরা পোশাক পরিহিত) জোর করে/ফাঁক-ফোকর দিয়ে অনেক বাঁধা অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করে। যা কিছু উচ্ছিষ্ট খাবার পাওয়া যায়, পলিথিনের ব্যাগে নিয়ে জমা করে। পরে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পরিবারের সবাই ভাগ করে খায়। এতেই তাদের সুখ ও আনন্দ। আর তথাকথিত বড় লোকদের খাবার না খেয়ে নষ্ট করার মধ্যে বিলাসিতা খোঁজে বেড়ায়। হায়-রে আজব বাঙালি। আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক লোক দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। যাদের একটা বড় অংশ ৩ বেলা নিয়মিত ও পরিমিত খেতে পারে না। সেখানে এরকম খাদ্য অপচয় করা বিলাসিতা নাকি অন্য কিছু ভেবে দেখতে হবে। আপনি নিজের টাকা খরচ করবেন, এতে কারো কিছু বলার নাই। কিন্তু অপচয়ের অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি নিশ্চয়।
পবিত্র হাদীস গ্রন্থে ‘অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই’ বলা হয়েছে। আমাদের অভিজাত শ্রেণীর ভদ্র লোকেরা খাবার নষ্ট করা’কে ফ্যাশন মনে করেন। অনেক শিক্ষিত লোকরা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক/অন্যের দেখাদেখি/অভ্যাসবশত খাবার নষ্ট করেন। প্লেটের সব খাবার শেষ করে খাওয়া যদি অভদ্রতা হয়; তবে আমি বলব-আমি সবচেয়ে বড় অভদ্র। প্লেট পরিস্কার করে খাবার খাওয়ার জন্য রাসুল (সঃ)-এর নির্দেশনাও আছে। অথচ আমরা তা ধারন করছি না/মানছি না। একটু খেয়াল করলেই আমরা অনেক খাবার অপচয়-এর হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। যার যতটুকু প্রয়োজন, সে ততটুকু খাবার প্লেটে তুলে নিলেই তো হয়। ছোটদের জন্য ছোট প্লেট এর ব্যবস্থা অথবা আলাদা ও তাদের উপযোগী খাবারের ব্যবস্থা রাখা উচিত। অতিরিক্ত/উচ্ছিষ্ট খাবার প্রয়োজনে গরিব দূঃখীদের মাঝে বিতরণ করলে সমস্যা কোথায়? তাতে অন্তত কিছু লোকের ক্ষুধা নিবারণ হবে, আবার সব খাবার সঠিকভাবে কাজে লাগবে। কোন প্রকার অবচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। দাওয়াত খেতে অথবা কারো বাসায় বেড়াতে যাওয়া আজকাল কমে যাচ্ছে। যৌক্তিক কারণ ও আছে-
১) সময়ের অভাব,
২) অতিরিক্ত খরচের কথা চিন্তা করে অনেকে বেড়াতে যেতে চান না। বেড়াতে গেলে ১০/১৫ কেজি অমুক/তমুক নিয়ে যেতে হবে। আর এতে করে খরচের মাত্রাও বেড়ে যায়। আবার এমন কিছু নিয়ে যাওয়া হয়, যা ঐপরিবারের কোন কাজেই লাগে না। যেমনঃ ১০-১৫ মিষ্টি/রসগোল্লা কোন বাসায় নিয়ে গেলে দেখা যায় যে, ঐ বাসায় অনেকেরই ডায়াবেটিস আছে অথবা মিষ্টি পছন্দ করেন না। সুতরাং মিষ্টি ঐপরিবারের লোকদের জন্য ক্ষতিকর। যেহেতু রেওয়াজ আছে নিতে হবে। তাই নিয়ে যাওয়া। কেউ খেতে পারলো না পারলো বিবেচ্য নয়। অথচ ভারতের লোকজন খুবই হিসেবী-এসব ব্যাপারে। যেমনঃ কারো বাসায় যাবে, কেবল মাত্র ৪-৬ টা কলা/মিষ্টি নিয়ে যাবে (পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচ্য)। আর আমাদের এখানে পরিবারে কয়জন সদস্য আছেন; দেখার সময় নাই। যত বেশি কেজি অথবা বড় প্যাকেট নেয়া যাবে, ততই নাকি মান-সম্মান বাড়বে(!)। নিজেকে বড় মনের লোক অথবা সম্পদশালী প্রমাণ করতে হলে তো খরচ একটু বেশীই করতে হবে(?)। আসলে জাতি হিসেবে আমরা চরম বেকুব অথবা বেহিসেবী। একটু চিন্তা করলেই উল্লেখিত বদনাম/দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আমার এক সহকর্মী ভারতে তার বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গেলেন। এক সন্ধ্যায় তার ভাই ও ভাবী’সহ ঘুরতে/শপিংয়ে গেলেন। হালকা নাস্তা-পানি খাওয়া হ’ল। বাসায় ফিরলেন। রাত্রে বাসায় রান্না-বান্নার কোন আয়োজন হচ্ছে না দেখে বড় ভাইকে প্রশ্ন করলেন-দাদা তোমরা ভাত রান্না করছ না যে? দাদা উত্তর করলেন-কেন? আমরা না খেয়ে আসলুম সবাই? আমার সহকর্মী তো অবাক, -বলো কি দাদা? আমি তো ভাত না খেলে….. রাতে ঘুম হবে না।
জার্মানিতে দুই বাঙালি এক রেস্তোরায় খেতে বসলেন। সমান্য কিছু খেয়ে প্লেটে প্রায় সব খাবার রেখে বের হবেন। এমন সময় এক ভদ্রলোক অনুরোধ করলেন খাবার নষ্ট না করতে। আর অমনি বাঙালি বাবুদের সাফ সাফ উত্তর (অনেকটা বাংলা সিনেমার সংলাপ) আমার টাকায় আমি খাবার কিনেছি। আমি খাব না, তাতে আপনার কি? ভদ্রলোকটি বেশ রাগান্বিত হলেন। ১৬৭৯ নম্বরে কল করলেন। এসএস (Social Service-এর দু’জন লোক হাজির। এসএস সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন-Order what you can consume, money is yours but resources belong to the society. There are many others in the world who are facing shortage of resources. You have no right to waste of resources. যাদের সামর্থ্য আছে, তারা পর্যাপ্ত খরচ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে কোন অবস্থায় যেন অপচয় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সমাজের অপসংস্কৃতিসমূহ দূর করতে হবে। আত্মীয়দের অধিকার ও প্রতিবেশীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। বাস্তবতার নিরীখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কাউকে অভূক্ত রেখে কোন মুসলমান ঘুমোতে যেতে পারে না। খাবারের সকল ধরনের অপচয় রোধ করতে হবে। সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য খাটতি থেকে দেশকে বাঁচাতে ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করতে হবে। খাদ্যের অপচয় রোধ করতে হবে দৃঢ়ভাবে। খাবারের অপচয় কখনও ভদ্রতা/ফ্যাশন হতে পারে না, এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে সকলকে। সমাজে সকল স্তরে বৈষম্য দূর হোক, মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটুক। মানবতার জয় অবিসম্ভাবী
লেখক: কবি ও কলামিস্ট
২ Comments
খাবারের অপচয় আমার দৃষ্টিতে মানবতা বিরোধী অপরাধ।
ভালো একটা আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন প্রিয়কবি।
thanks