২৩৩ বার পড়া হয়েছে
খাতুনে জান্নাতের ‘‘নিরন্তর রোদের মিছিলে’’ পাঠ প্রতিক্রিয়া
কাদের মাহমুদ
বহু বছর পরে একটি কবিতার বই পড়ে মুগ্ধ হলাম। সকল পদ্য কবিতা হয়ে ওঠে না। আবার কোন কোন কবির কবিতা কঠিনতর প্রলেপ জড়িয়ে পাঠের পথ দুর্গম করে তোলে। অবশ্য আমরা জানি, কাল হচ্ছে কবিতার কালান্তরের কষ্টি পাথর।
প্রথমে আমি এ সঙ্কলনের একটা বৈশিষ্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি:
* সঙ্কলনটিতে একজন নারী কবির ভাষায়–শৈশব, কৈশোর ও যৌবন– এই তিন কালের নারীর জীবন, নারীর অনুভূতি, নারীর অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল এক গুচ্ছ কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে ১১টি ও পরোক্ষভাবে ৪টি কবিতা রয়েছে। এই সমাবেশ অসাধারণ বলে আমার মনে হয়ে হয়েছে।
* তবে খাতুনে জান্নাত বোধ হয় নিজেকে নারীবাদী ভাবেন না। তার কবিতা সংস্কারমুক্ত, সরল ও দৃঢ় উচ্চারণে বলিষ্ঠ। সঙ্কলনে কতটুকু খোলা তা পাশ্চাত্য জীবনের উপর কবিতাগুলো অনেকটা ইশারা দেয়।
* তার কবিতায় অসাম্প্রদায়িক বাংলার ছবি দূরন্তভাবে ফুটে উঠেছে।
* কবিতায় একটি রাবিন্দ্রিক প্রবাহ আছে। সে প্রবাহ থেকে নিজ কবিতার স্রোতকে স্পষ্টতই নিজস্ব করে নেবার প্রচেষ্টা দেখা যায়। এর কারণ হয়তো এই যে, চিরায়ত বাংলার ছবি, রূপ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা দিয়ে শীতলপাটির মতো জীবন অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট বিছিয়ে তার কবিতার রচনা।
* এই যে, শীতলপাটির প্রেক্ষাপটের কথা বললাম, এর মধ্যেও পুরুষের চোখে যা ধরা পড়ে না নারীর চোখে অনায়াসে ধরা পড়ে সেইসব কারুকাজ আছে কবিতায়।
* কবিতার কোন কোন ক্ষেত্রে ছোটগল্পের মতো মোচড় রয়েছে; সেখানে না- পৌঁছে কবিতাটাই অজানা থেকে যায়।
* কোন কোন কবিতা খন্ডচিত্র, ধাঁ ধাঁ বা রহস্যময় মনে হয়(তরুণীর ভাগ, বসন্তের কান্না)
* কবিতায় সর্বোপরি একটা আশাবাদ আছে–দুঃখ-বেদনা,(স্বদেশে ফিরতে না পারার) ক্ষেদ থাকলেও সর্বপ্লাবী হতাশা নেই। সঙ্কলনে কবিতার দুঃকষ্টের সাথে একটি মিষ্টি আবেগ জড়িয়ে আছে। কাব্য গ্রন্থটির নামই তা প্রমাণ করে।
কবিতার অন্যান্য প্রধান বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে জীবনবোধ, প্রবাস জীবন ও এর অভিজ্ঞতা, পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও নগ্নতা, কবি জীবন ও তৃষ্ণা ও প্রেম( তবে প্রচ্ছন্ন অথবা বাস্তবের কাদাজলে মাখা-দূর্বার ভালোবাসা নয়), সমাজ চেতনা এবং মানবিক বোধ।
* ‘ন আর্য’ অতি চমৎকার ভাবের কবিতা
* ‘নগ্নতা’ দুঃসাহসিক কবিতা। একইসাথে ‘মিলনোৎসব’ একটি মানবিক কবিতা
সঙ্কলনের কবিতাগুলোয় মনোরম উপমার বিপুল সমাবেশ ঘটেছে, ফলে পঙক্তিগুলো জ্বল জ্বল করে। কিছু নমুনা দিচ্ছি:
‘বালিকা মেঘদল’ (পাড়ি), ‘গোল্লাছুট বিকেল’ (এখনো তোমার জন্য); ‘জংলা সিঁড়ি’ ( উড়োডানার অক্ষর); ‘ঠকাঠক কাঠের খড়ম’ (আমার গাঁয়ের কথা); ‘পুঁই কুঁড়ুনী’ (সুখ); ‘ও নারী/ ভিরুতা নয়–পায়ের ঘুঙুরে তোল ঝড়’ (নারী); ‘প্রবৃত্তি তোরণ‘ (বিবর্তন); ‘চুলের অরণ্য লুটেটুটে নিতে চায়/ জলের মোহনা…/লাউ’র মাচানে ঠোঁটে জোড়া কবুতর/ কিশোরী হৃদয় কাঁপে থরো থরো থর‘ (কালের কিশোরী); ‘এসো জীবনই রাখি জীবনের বেদীমূলে’ (আহ্বান); ‘দিনের শরীরে বৃষ্টির পোশাক’ (হিরন্ময়ী দিন); কালের আঁচলে কলির সুবাস ঢেলে/ দিন ছুটে চলে‘
(কেন্দ্রবিন্দু); ‘নির্ভয়ে কাঁদতে পারি তাদের স্মরণে/ ভালোবেসে যারা প্রাণ দেয়’ (মানুষের মতো); ‘লাজুক লাজুক ভোর রিকসার হুড তোলা ‘ (উঠতি অনুরাগ); ‘কাড়ে যুবতীর জিত জীবন’ ( চাবুক); ‘‘ বিশ্রামরত শ্রোতৃবৃন্দ এগিয়ে আসে না’ (অব্যক্ত ভাষ্য); ‘ধানচারা কচি ডানা মেলে/‘ ডুবে আছে কাদাজলে’ (শিকড়ের ডাক); ‘নিয়মের নথিফাঁস’ (দোটানা); ‘ডিমপাড়া মুরগির খুশি’ …শিশুকাল এত কাছে হাঁটাহাঁটি করে/ চেয়ে থাকি বিস্ময় জড়িয়ে’ (দায়);‘ এক বিন্দু শিশিরের অভিমান’ (অভিমান); ‘করি মেরামত/ আজীবনের ভগ্ন সিন্দুক’ (পরিক্রমণ); ‘পোড়াবে কি নতুন করে/ পুড়ছি হাজার বছর ধরে’ (পোড়ন); ‘অনিচ্ছার গুন টেনে ধরে যেতে হবে’ (যাচ্ছি সেদিকে)।
‘বাস্তব বিষ’ ও ‘আমার গাঁয়ের কথা’ মনে হয় অন্তমিলের সনেটধর্মী কবিতা। আমি ছন্দকানা তাই এ বিষয়ে কিছু বলবো না। তবে ‘আমার গাঁয়ের কথা’ গ্রামীন শব্দ ও পরিবেশের অতল স্পর্শ করেছে। ‘নিস্তব্ধ রাতের কথা’ সঙ্কলনের দীর্ঘতম কবিতা।
‘বৈশাখি স্টল’ কবিতাটা অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যেকোন নতুন কবি বা সাহিত্যিকের অনুভূতি এখানে মিষ্টিভাবরসের বিন্যাসে বিধৃত। পুরনোদেরও নতুন বইয়ের ব্যাপারে বইমেলায় এ উৎসুক্য থাকা স্বাভাবিক। পুরো কবিতাটি এরকম,
‘`অনেক বই‘র ফাঁকে আমার একটি বই
আচমকা উঁকি দেয় বৈশাখি মেলার স্টলে।
আমি আড়চোখে খদ্দেরের নাড়াচাড়া দেখি-
প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ছাড়িয়ে পলক পড়ে কিনা
গ্রন্থভূক্ত লিপিকায়;
যে বাণীতে মিশে আছে নিদ্রাহীন রাত, জলন্ত-সলতে
সুখ-দীর্ঘশ্বাস সন্মিলিত আলোড়ন।
রাঙিয়েছি রথ তার আজীবনে ছেঁকে নেয়া রঙের বাহারে।
ঘামের অতলে নেয়ে তালপাখার বাতাসে মেখেছি
—-মায়ের কলাপাতা শাড়ির আঁচল।
বুকেপোষা বুলবুলি সুরে ভ‘রে তুলেছি রাত্রির অবাধ্য প্রহর।
ডাহুকের ডাক শেষে রক্ত ক্ষরণের মতো
আমার হৃদয়ক্ষরিত অনুভবে অংকিত লেখনি
ছোঁয় কিনা কারো আগ্রহের মৃদুপরশ,
মনোযোগের মধুর মহিমা—
আমি ভ’য়ে ভ’য়ে দেখি
লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখি
বৈশাখি বই‘র স্টল।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন বড় মাপের কবি। তিনি নিজে খাতুনে জান্নাতের এ সঙ্কলনটি প্রকাশ করেছেন, এ একটি বড় আনন্দের কথা। ‘কৃত্তিবাস একটি ঐতিহাসিক নাম জড়ানো কবিতার সাথে এও একটি সৌভাগ্যের কথা।
এবার কয়েকটি তিক্ত কথা বলবো, যা কবির কাছে তেতো ঠেকলেও আহত করবে না বলে আশা করি।
* বানানের বিষয়ে আরও সতর্কতা প্রত্যাশা করছি কবির কাছে। বাংলা একাডেমীর প্রমীত বানান রীতি অনুস্মরণযোগ্য।
* কবিতায় অর্থ প্রকাশেকমা(,), সেমিকোলন(;), ডেস(্) ইত্যাদির ব্যবহার অপরিহার্য। বাংলায় উর্ধ্বকমার(’) ব্যবহার সীমিত তবে যা আছে তা খুব প্রয়োজনীয় ব’লে মনে করছি।
* শিশুর শরীরে মাতা’–এ তত্ত্বটা কি বিজ্ঞানসম্ম্তভাবে সঠিক।?
* পালিয়ে যে সুখ যায় হারিয়ে তা বাস্তবের বিষে/নদী আর নারী তাই একসাথে থাকি মিলেমিশে। (বাস্তব বিষ)
এখানে কি পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আছে? যদি তা-না হয় তাহলে ‘তাই’ এর বদলে‘তবু’ জাতীয় শব্দ থাকা বাঞ্চনীয়?
* সঙ্কলনের কবিতাগুলোর সাথে স্থান ও কাল দেয়া নাই। থাকলে পাঠকের পক্ষে কবিতার প্রেক্ষাপট এবং কবির অবস্থান বুঝতে পারা সহজ হতো; বিশেষ ক’রে যেখানে কবি বসত করছেন বিলেতে, তার মানসিক দেশ বাংলাদেশ ও সঙ্কলনের প্রকাশ ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে(ভারতে)।
সৃজনশীলতা নিয়ত কঠিন-কঠোর সাধনা; বিলেতের ছক-বাঁধা জীবনে সন্তান-স্বামী নিয়ে ঘর-সংসার করার মাঝেও খাতুনে জান্নাত যে বাংলা কবিতার চর্চা করছেন, তা ব্যতিক্রম। অবশ্য কবির প্রতিভা তার কবিতাকে উজ্জ্বল করেছে। তবে প্রতিভাকে পাঠে, জ্ঞান-বর্ধনে, অভিজ্ঞান-সম্প্রসারণে, সামাজিক ভীতি-উৎরানোর মাঝ দিয়ে এবং নিয়মিত চর্চায় শানিয়ে রাখতে হয়। কবি নিত্য ও অনিত্য দুয়ের খেলাতেই মত্ত হন। এ খেলায় খাতুনে জান্নাত আগামীতে আরো বৈচিত্র আনবেন ব’লে আমার বিশ্বাস। আমার আরো বিশ্বাস সামনে চলার দৃঢ় প্রত্যয় তার আছে।
কবির জয় পরিব্যপ্ত হোক। জয় হোক শুদ্ধ কবিতার।
কাদের মাহমুদ,
ইউ.কে