সময়
সময় রেখেছে ধ’রে বয়সের সকল স্মারক
মাঠের ফসল তোলে অপ্রসন্ন কৃষকেরা শোকে
হাজার বছর ধ’রে হেটে চলে ক্লান্ত পর্যটক
নূতন বৃক্ষের চারা মাটির গভীরে মাথা ঠোকে ।
মিশে গ্যাছে আর্তনাদ, মিশে গ্যাছে আনন্দের হাসি
বাসর হয়েছে সাঙ্গ, খেলাধুলা শেষ হ’য়ে গ্যাছে
প্রবীণ প্রাচীণ মাটি, আজো কিন্তু হয় নাই বাসি
জন্ম দিতে কী ব্যাকুল বারবার শরীর কেঁপেছে ।
অন্ধকার রাত নামে, ঢেকে দ্যায় সব চঞ্চলতা ।
কবরের পাশে কোন আঁতুড়ঘরের শিশু কাঁদে
মরা ডাল স’রে যায়, কচি ডগা আয়োজন ফাঁদে ।
রাত জেগে প্রবীণেরা কথা বলে, কার কোন কথা?
নূতন নির্মাণধ্বনি ভেসে আসে পেরেকের গানে
গভীর জীবনে তার চঞ্চলতা মাখামাখি ঘ্রাণে ।
জালের গল্প
চাষী বুনেছিলো তুলো গাছ আর
তাঁতিরা-জোলারা নয়, মিলের শ্রমিক
মুদির বধূর জন্য (আরো অনেকের জন্য)
বৈদ্যুতিক তাঁতে সুতো বুনেছিলো
সেই তুলো দিয়ে।
সেই নারীকষ্টে-পাওয়া অবসর শ্রমদিয়ে
পরিপাটি জাল বুনেছিলো বটে ।
জালের ভিতরে
জলের ভিতরে
খল্বলউচ্ছল মাছের স্বপ্নেরা
করে বসবাস।
অদৃশ্য মাছেরা ধরা দেবে ব’লে
নগদ মুদ্রায় কেনা হ’ল সেই জাল ।
মাছতো দূরের কথা
মৃত প্রাণী স্বপ্ন দেখতে পারে?
মাটির মর্যাদা
কৃষক জানেন কিছু জমিনের হাল-হকিকত
এঁটেল মাটির মর্ম, কিংবা বালি, পলি আর সার-
শ্রমের, ঘামের দামে- বিনিময়ে- বিপুলকর্ষণ,
বিশেষজ্ঞ ঠিক নন, মাটি-ধর্মকৃষক জানেন ।
দরিয়ার মাঝি, জেলে চিনে আকাশ আর পানি-
মিঠা, লবণাক্ত, ঘোলা, শান্ত আর আঁকাবাঁকা জল
বাতাসের সঙ্গী পেলে কী রকম আচরণকরে
সবই তার জানা আছে । মেঘের মিনারে প্রীতিভীতি
ক্রোধ, স্নেহ, ভালোবাসা-এসব কন্ঠস্থ মাঝির,
তার দৃষ্টি মাটি খোঁজে, স্মৃতিতেও মৃত্তিকা অম্লান।
তবু
মুক্তিযোদ্ধা দিতে জানে পরিপূর্ণ মাটির মর্যাদা।
ব্যার্থ শিল্পীর স্বীকারোক্তি
সাপিনীর সেই মোহন অভিনন্দন
আমাকে প্রলুব্ধ করলো ।
আমি তুলিটি রঙে ডুবিয়ে ব’সে আছি-
আসলে বলা ভালো, অপেক্ষাই করছি ।
দুধ-দোহানোর চিরচির ছন্দে
সূর্য উঠলেন গগনে ।
আমি আকাশে তুলি চালালাম ।
আর কয়েক কোটি প্রজাপতি ঝ’রে পড়লো ।
‘তুলি শুকানোর প্রতীক্ষা
শীত-রাত্রির মতোই দীঘল ।
আমার এই ভাটিয়ালী শুনে
বুড়ো মাঝি খকখক ক’রে কেশে
নৌকার কাছি খুলে দিলেন ।
বাতাসেও পদচিহ্ন
মাথা নয়
জন্ম-গোধূলিতে সূর্য ছুঁয়েছিলো
নরম, রক্তাক্ত দু’টি হাত ।
শান্ত, মৌন অরণ্যর ব্রহ্মচর্যে
স্তব্ধতার স্বর
প্রয়োজনহীন জলের শরীরে ঝাঁকি দেয় ।
সেখানে তৃষ্ণার জল ঠোটে চাটে মোহন সন্ত্রাসে ।
শক্তি আর হিংসার যুগলবন্দি ঠোঁট
বাতাসেও পদচিহ্ন আঁকে ।
নিকারি ও বাওয়ালীর গাঢ় স্বপ্ন, দম্ভ, প্রয়োজন
একে-একে গুড়ো হয়, রেণু হয়, ক্রমে মিশে যায় ।
সমস্ত ভূবনব্যাপী রণক্লান্ত থাবা প’ড়ে থাকে ।
কেবল হরিণ জানে, হরিণীর ম্লান চোখ জানে
কোন ঘাটে আকস্মাৎ বাজুবন্ধ খ’সে প’ড়ে যায় ।
পুরোনো দীর্ঘশ্বাসের কী হবে?
দীর্ঘশ্বাসগুলো কোন পকেটে যে রাখলাম?
খুঁজেও পাছি না ।
এ-রকমই হয় ।
অন্তত একটা বড়ো-সড়ো দীর্ঘশ্বাস
আমার এখন বড়ো প্রয়োজন ।
বাক্যের মাঝখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলে
কিছুক্ষণ চুপ থেকে
ধীরে ধীরে বাক্যটা শেষ করতে পারলে
ধার-টার পাওা যেতো ।
পাগোলের মতো পকেট হাঁতড়েও
আগেকার জমা, না-ভাঙ্গানো
একটি দীর্ঘশ্বাস অ পেলাম না ।
আর তখনই
গভীর, বিপুল, সাত-আমাবস্যা-আকারের
দীর্ঘশ্বাস জন্ম নিলো ।
আমি মহাখুশি
কিন্তু ধার পাওয়া গ্যালো না ।
তা হ’লে পুরোনো দির্ঘশ্বাসের কী হবে ?
আমার দুঃখ-টুঃখ
এই বুঝি শেষ দুঃখ,
এরপর অন্য কোনো দুখ-টুঃখ নেই,
দুঃখ তার যবনিকা ফেলে দিয়ে চলে গ্যাছে শেষে-
আমিও বাহিরে এসে সিগ্রেট ধরাবো
সমস্ত দুঃখের বাইরে ভাসাবো সাঁতার ।
আরেক রকম দুঃখ ভিন্ন ব্যথা গায়
দরোজায় টোকা দ্যায়,
সুখ ভেবে তাকে আমি বারবার তোয়াজ করছি
নাকি সেই লোভে
করুণ ভিখিরি হ’য়ে
দুঃখগুলো ঘরের চৌকাঠে প’ড়ে থাকে।
বিত্তনাই, বেসাত নাই
(মির্জা গালিবকে)
এখনো ছোটোমোটো আছো নাকি হে, যে,
যা-ভাববে তাই ঘটবে?
খালি পকেটে হাত দিলেই
রাশি রাশি ভাঁড়া ভাঁড়া টাকা
প্রজাপতির রঙিন ডানা নাড়বে?
এখনো ছোটোমোটো আছো নাকি হে, যে,
জানালার দিকে না তাকালেই
অন্ধ, বধি ভয়গুলো চ’লে যাবে?
আর অবিরাম চোখ মারবে হলুদ চাঁদ?
কাল অবশ্য এক কাবলি এসেছিল
এ-পাড়ায়;
তা আমার বাড়ি নয়।
বাহ সে আমার বাড়ি হতে যাবে কেন?
নির্জন উৎসব
অসহ্য উচ্চাশা নেই, শুধু প্রেম করি অনুভব,
ধাতে নেই খ্যাতির বারান্দা দিয়ে হাঁটা-হাঁটি করা ।
তবুও ময়ূর নাচে, ঝারে বারি, কখনোবা খরা
শুষ্ক জিভে চুষে নেয় কল্লোলিত আনন্দ, উৎসব ।
প্রদীপের ছায়া নেভে, যায় ছায়াদানকারী দেহ-
বেহায়া দোতরা গায়, ‘যা গেয়েছি, শেষ গান নয়,
ওগো সাঁই, মনে নাচে সত্য প্রিয় নিষিদ্ধ প্রলয়’…
জন্মান্ধ মেস্তরি বুকে শুধু গাঁথাবিশ্বাস/সন্দেহ ।
উৎসবে সাপিনী থাকে, সুচিত্রিত বর্ণীল নকশায়
প্রগাঢ় চুম্বন গাঁথে সে-ফণায় জেদের আবেগে-
বেঢপ বাস্তব নিয়ে দশটা-পাঁচটা ওঠে রেগে,
‘সর্বনাশ ছোঁবো আমি’- এতে নেই সংসারের সায় ।
তোমার দু’চোখে শুধু প্রিয়তমা জ্বেলে রেখো আলো,
নির্জন উৎসবে তুমি আনো শান্তি, আনো নিত্য ভালো ।
আজীবন অনুগত আমি
আশৈশব ‘সাত চড়ে রা’ নেই ছেলের,
শুনে শুনে
বড় বেশি হাবাগোবা, প্রতিবাদহীন
নিরাপদ, নিরীহ মানুষ হ’য়ে
সুখে দুঃখে আছি ।
অভ্যাসের ফলে ক্রোধে ও বিরক্তি আমি প্রকাশ করি নি
এখনো পারি না
আমি মুখ ফুটে ‘না’ বলতে পারি না
মাঝে মাঝে ময়ূরের মনোরম পেখম পরেছি
মিছিমিছি-
যেমন ছিলাম, আজো তেমন রয়েছি ।
লন্ড্রি ও সেলুন, চৌকস টেইলর ব্যর্থ হলো,
স্মার্ট হবার সুনাম অগোচরে রয়ে গেলো
আমার কী দোষ?
শুধু একবার ব্যতিক্রম হলো । কেন হলো?
এর কোনো সঠিক উত্তর নেই ।
শান্তশিষ্ট গোবেচারী নিরপেক্ষ নদী,
ছিমছাম রাস্তাঘাট,
মানুষ, মানুষী ইত্যাকার নিতান্ত অসহ্য মনে হলো ।
পলাকত হ’য়ে শেষে বিদ্রোহী সেজেছি ।
একে যদি দেশপ্রেম বলো, তাহলে আমার দেশপ্রেম আছে বটে ।
আমি চিরকাল অনুগত ।
সমাজের, সময়ের, স্বভাবের, অভ্যাসের,
আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস আমি-
প্রথা ও রেওয়াজের বাইরে গেলে
দারুণ অস্বস্তি লাগে-
বিশ্বাস করুন,
আজীবন অনুগত আমি ।
কানাডা প্রবাসী জীবন্ত কিংবদন্তি কবি আসাদ চৌধুরী
২ Comments
Excelling .
You are a great poet.