২২৬ বার পড়া হয়েছে
ছোটগল্প:
সংসার
কানিজ ফাতেমা
সত্যি তো, আবির কেন তার জন্য নিজেকে সকল আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবে বরং সে-ই দেশে চলে যাবে- ছলছল চোখে লীনা একমনে কথাগুলো ভাবছে-এমন সময় দরজার লক খোলার শব্দ কানে আসলো লীনার। আবির এসেছে বুঝতে পেরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে শুয়ে পড়লো সে। যে দিনগুলোতে অফিসের অনুষ্ঠান থাকে, ফিরতে দেরি হবে বুঝতে পারে আবির। সে সব দিনে আবির বাসা থেকে মেইন দরজার একটা চাবি সাথে নিয়ে যায় যেন লীনাকে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে না হয়।
আবির রুমে এসে আস্তে করে পাশে বসে লীনা বলে ডাক দিলো। কিন্তু কোন সাড়া না দেওয়ায় আবার উঠে নিজের কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটু চোখটা খুলে আবিরের চলে যাওয়া দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল লীনার। আবির তাকে ডেকে কথা বলার চেষ্টা করলো না পর্যন্ত। লীনার চোখে পানি চলে আসলো। বেশ কিছু সময় কেটে গেল আবীর পাশের ঘরে, কি করছে আবির? একবার ভাবলো উঠে গিয়ে দেখবে। আবার মনে হল না আবিরের তার জন্য কোন ভাবনা নেই তো সে কেন যাবে?
বেশ কয়েক বছর আবির ও দুই বাচ্চার সাথে বিদেশে বসবাস করছে লীনা। খুব সুন্দর দেশ কিন্তু সুখের জীবন বলতে মন চায় না তার। একা সারা সংসার সমলাও, বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা নেওয়া, বাজার করা সাথে মেহমানদারী করা- সব একলা হাতে সামলাতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে লীনার মনে হয় দেশে থাকতে যে দুজন কাজের মহিলা ছিল তারা বোধ হয় লীনাকে অভিশাপ দিয়েছে তাই তারা যে কাজগুলো করে তাকে সাহায্য করতো সে সব কাজ এখন এখানে এসে লীনাকে একা করতে হচ্ছে । তার উপর স্বামীর সাথে লৌকিকতা সামাজিকতা মেনে চলতে হয় সমানতালে। ইদানীং আর পেরে উঠছে না লীনা। হঠাৎই কেমন যেন শরীরটা খারাপ হতে শুরু করেছে তার। এই দেশের বড় বড় ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা করিয়েও কিছু ধরতে পারে নি। তবুও তার ভালো লাগে না শুধু দেশে ফিরে যেতে মন চায়।
দেশ থেকে প্রথম যখন এসেছিল তখন নিজেকে দশ হাতে কাজ করা মানুষ মনে হলেও ইদানীং শরীরটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় খুব অসহায় লাগছে তার। সেই কারণে কদিন হলো সব ভয় চিন্তা বাদ দিয়ে বাচ্চাদের আনা নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে ড্রাইভারের উপর। নিজেকে বাসায় বন্দি করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে।
এদিকে ইদানীং স্বামী আবিরের অফিসের অনুষ্ঠানের ঝড় চলছে একটার পর একটা পোগ্রাম। লীনা সাথে যেতে চাইছে না বলে আবির একটু মনও খারাপ করছে। তার জন্য বাচ্চাদেরও ঘুরতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে সময়টা ভালো যাচ্ছে না লীনার।আজও একটা দাওয়াত ছিল আবির অফিস থেকে ফোন করে বার বার বলল- চলো না যায় লীনা, ভালো লাগবে তোমার। সত্যি লীনারও ভালো লাগে যখন অাবিরের সাথে সেজে পরিপাটি হয়ে কোথাও বেড়াতে যায়। কারণ সাজগোজ করে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হওয়ার সময় আবির যখন সুন্দর লাগছে বলে সেই শব্দ দুটি লীনার জীবনে অনেক ভালোলাগার শব্দ। আবিরের চোখে সুন্দর লাগবে বলেই তো এত সুন্দর করে সাজে সে। যাই হোক, বিগত কিছুদিনের মত আজও সে যেতে রাজি না হওয়াতে বাচ্চাদেরও যাওয়া হলো না। আবির একাই অনুষ্ঠানে চলে গেলে লীনার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
আজ নিজেকে বচ্চাদের সামনে কেমন অপরাধী মনে হল লীনার। তাদের আনন্দগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে সে। আবার ভয়ও হচ্ছে লীনার, সে যদি আর সুস্থ হতে না পারে! তাহলে তার বাচ্চা দুটির কি হবে? আবিরতো ঠিকই বিয়ে করে নতুন করে সংসার শুরু করবে ভেবে মনটা খারাপ করে কিছু সময় বসে রইলো। তারপর উঠে বাচ্চাদের খেয়ে নিতে বলল।
অসুস্থ হওয়ার পর থেকে দুই বাচ্চাকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য খাওয়া থেকে সব কাজ নিজ হাতে করতে শেখাচ্ছে সে। যেন মা না থাকলেও তারা নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নিতে পারে। যদিও বড় জনের বয়স দশ আর ছোট ছেলেটির বয়স পাঁচ তবুও আর মুখে তুলে আদর করে খাইয়ে দেয় লীনা- এই ভয়ে যদি সত্যি সে আর কখনো সুস্থ না হয়।
সেই ধারাবাহিকতায় আজও বাচ্চারা টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবার নিজেরা তুলে নিয়ে খেয়ে ব্রাশ করে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত এগারোটা বাজে আবির এখনো বাসায় ফেরেনি। এদিকে লীনার মাথার মধ্যে একটার পর একটা নেতিবাচক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সাথে একটু একটু করে অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করছে লীনার মনের মাঝে। মনে মনে ভাবছে হয়তো সে অসুস্থ তাই আবির তার প্রতি বিরক্ত হতে শুরু করেছে আর কিছুদিন পর হয়তো আর ভালোই বাসবে না- কথাটা ভেবে চোখ ছলছল করে উঠলো। সত্যি কি আবির তাকে ফেলে চলে যাবে ভাবতে ভাবতে কষ্ট রাগ দুটোই বাড়তে লাগলো লীনার। এদিকে খুব খিদাও লেগেছে লীনার । আজ শুধু মার কথা মনে পড়ছে। অসুখ হলে মা সব সময় মুখে তুলে খাইয়ে দিত। ধূত দেশেই ভালো ছিলাম! কেন এই বিদেশে এলাম এখানে মরে গেলেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আবির বাসায় আসার পর লীনার মনের মধ্যে অভিমান অভিযোগের মেঘ বৃষ্টি হয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আবির তাকে নিয়ে একটুও ভাবে না।
এর মধ্যে হঠাৎ আবীর ঘরে এসে তাকে হাত ধরে টেনে চাপা স্বরে উঠে বসতে বললো।
কিন্তু লীনা অভিমান করে তবুও চোখ খুললো না।
আবীর চাপা স্বরে বলল শোন আমি জানি তুমি জেগে আছো উঠো না হলে জোরে কথা বলবো আর বাচ্চারা জেগে যাবে।
এবার লীনা মুখ ফিরিয়ে চাপা স্বরে বলল কি হলো? এতক্ষণ তো খুব মজা করে এলে, এখন ঘুমাও, আমাকে উঠতে হবে কেন?
জি ঘুমাবো, একটু এসো, দরকার।
আমি পারবো না আসতে।
হুম পারবে না। না উঠলে কোলে করে নিয়ে যাব।
এবার রাগ করে লীনা উঠে বসে বিরক্ত হয়ে বলল এখন কি জন্য ডাকছো?
চলো বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সোফায় বসালো তাকে। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে একটা প্লেটে খাবার নিয়ে এসে বলল জানি তো রাগ করে না খেয়ে শুয়েছো।
অফিসের প্রোগ্রাম- না গেলে ঝামেলা হয় তুমি তো জানো। তবুও রাগ করবে- বলেই বলল হা করো।
না আমি খাবো না, লীনার অভিমানী উত্তর শুনে আবির অস্থিরতা দেখিয়ে বলল তাড়াতাড়ি খাওতো আমিও খাবো খুব খিদা লেগেছে।
হুম খেয়ে এসে ঢং করছো তাই না?
হুম ঠিক বলেছো, এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও ঘুমাতে হবে- বলে মুখে খাবার তুলে দিল আবীর।
লীনার চোখ আবারও ছলছল করে উঠলো।
আমাকে দেশে পাঠিয়ে দাও।
কেন?
আমার জন্য তোমার সমস্যা হচ্ছে।
কে বলল?
আমি বলছি।
চুপ চাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। তোমাকে পাঠিয়ে দিলে আমি এখানে একা একা কি করবো? সারাদিন পরে একসাথে থাকি বলে কত টেনশন মুক্ত থাকি তুমি বোঝো? আর যেতে হলে একসাথেই ফিরে যাব। এসব চিন্তা করোনা তো। আর শরীর খারাপ, না খেয়ে কেন শুয়েছো?
তোমার উপর রগ করে। বলে হাসলো লীলা। আবির একটা কথা বলবো তুমি না ঠিক আমার মার মত করে আমাকে আগলে রাখ।
হুম এত বোঝো তবুও অভিযোগ আর অভিযোগ- বলে হাসলো আবির।
আর খাবোনা তুমি খেয়ে নাও।
পাগল আমি মজা করে খেয়ে এসেছি। তুমি খাওনি বলে মিথ্যা বলেছি। তবে তুমি গেলেও খুব মজা হতো।
আমি বোধ হয় আর কোনদিন তোমার সাথে বেড়াতে যেতে পারবো না- বেশ মন খারাপ করে বলল লীনা।
কে বলেছে যেতে পারবে না। মানুষ সব সময় অসুস্থ থাকে না বুঝেছো। কি ঘরে যেতে পারবে? না কি কোলে তুলতে হবে বলে হাসলো আবীর।
হুম কোলে তুলে শেষমেশ ফেলে দিয়ে আমার কোমরটা ভেঙে দাও।
ভাঙলে ভাঙবে।
হ্যাঁ তারপর বলবে কোমর ভাঙা বৌ ভালো লাগে না।
কে বলছে ভালো লাগবে না। তুমি শুধু হাসিখুশি থাকবে তাহলেই আমার ভালো লাগবে।
কেন?
কারণ ভালোবাসি তোমায়। সারাজীবন একসাথে থাকতে চাই।
লীনা কেঁদে ফেলল।
কাঁদছো কেন? সেই বিয়ের পর থেকে কেঁদেই চলেছো।
তাহলে বোঝো কি কপাল আমার।
আহারে কি দুঃখ আমার বৌটার! চলো আর কান্নাকাটি করা লাগবে না।
চোখ মুছে লীনা আবিরের হাত ধরে ঘরে আসার সময় বলল আমি এমন সুখের কান্না মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কাঁদতে চাই আবির।
হ্যাঁ এমনিতেই কম কান্নাকাটি করো যে আবার অগ্রীম জানিয়ে হুশিয়ারি দিচ্ছো?
আবির হাসি মুখে কথাটা শেষ করতেই লীনাও হেসে একটু জোরে আওয়াজ করে কথা বলে উঠতেই বড় বাচ্চা ঘুম থেকে জেগে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো রোজ রোজ এতো রাতে জেগে বসে বসে কি কথা বলো তোমরা? আমাদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। আর বাবা তোমারও তো সকালে অফিস। আলো নিভিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। বেশ শাসনের সুরে কথাগুলা বলেই আবার ঘুমতে চেষ্টা করতে লাগলো সে। আর লীনা ও আবির প্রবল ভালোবাসা মমতা নিয়ে বাচ্চা দুটির দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে তাদের সংসার নামের সাজানো বাগানে দাঁড়িয়ে সুখের অনুভবে বিভোর হয়ে রইলো ।
——–কানিজ ফাতেমা——
২ Comments
congratulations.
ছোট গল্পটি বাস্তবতার পাশ কাটিয়ে কিছুটা সহজ ভঙ্গিতে গল্পের কলেবর ও অতিরিক্ত পার্শ চরিত্র না এনে খুব সহজ ভাবে ছোট্ট করে যেভাবে এদেশের সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছে তা দেখে আমি সত্যি অভিভূত।
এক কথায় ছোট গল্পটি অনন্য অসাধারন লিখেছেন বোন
কানিজ ফাতেমা।