কবি-লেখক হিসেবে নারী কেন বেশি দূর যেতে পারে না
যিনি কবিতা লেখেন– তিনি কবি। এই পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোনও লিংগভেদ নেই। যদিও বেশ আগে ব্যাকরন বইতে পুংলিংগে কবি, আর বিপরীতে স্ত্রী লিঙ্গে মহিলা কবি শব্দটি মুদ্রিত ছিলো। আমাদের ক্লাস টিচার কিন্তু আমাদেরকে সেই সময়েই ধরিয়ে দিয়েছিলেন কবি ‘কবি”ই।‘ মহিলা কবি ‘বলতে কিছু নেই। প্রারম্ভিক এই কথা গুলোর তাৎপর্য বা অবতারনার উদ্দেশ্য, উপস্থাপন ব্যাখ্যা এই দুটি বিষয়ে পরে আসছি। আগে কবির স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে দু’চারটি কথা বলি।
কীভাবে কবি কবিতা লেখেন? কি ভাবনায় ভাবিত হন কবি? কি তাঁর মনোভুবনের রুপ?
কার্ল গুস্তভ ইয়ং বলছেন– ‘সৃষ্টির উপকরণ আসে অবচেতনের অতল থেকে। সচেতন স্তরের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব নিয়ে যখন মানুষের মনে যখন কোনও সন্দেহ তৈরি হয় না, সেখানে অবচেতন স্তরের উপকরণ সম্পর্কে তো কোনও প্রশ্ন তৈরি হবার অবকাশ আসে না। কারণ অবচেতন মানুষের অধিকতর তাৎপর্যবাহী অংশ। সচেতনে মানুষ যে সব কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাই জমা হয় অবচেতন বিবিরে। স্বপ্ন সে সব অভিজ্ঞতাকে পরিপূরনের কাজ
করে সংগোপনে। ‘কবির চেতনায় থাকে অতীন্দ্রিয় জগত এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতার সহযোগ। দুইয়ের সম্মিলিত ভাষারুপ হচ্ছে কবিতা, কিংবা কবিতার মতো সৃজনকর্ম । সৃজনকর্ম গুলোর স্রষ্টা কিংবা শিল্পীর বাহ্যিকরুপ সবসময়ই তার সৃষ্টই কর্মের মতো অপরুপ হয় না। কবির কবিতা পড়ে অদেখা কবির যে চেহারা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, তার সংগে বাস্তব অবয়বের সাদৃশ্য মোটেও থাকে না। বরং বলা যায় প্রায়শই তুলনামুলকভাবে অসুন্দরই মনে হতে পারে। কিন্তু কবির ভেতরের যে কবিমন, তারই অপরুপ সৌন্দর্যের প্রতিরুপ তাঁর সৃষ্টি কর্ম।
বস্তুর অস্তিত্ব থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে কবি সৃষ্টির জন্যে তাড়না অনুভব করেন, তার অনুপ্রেরণার চাকায় ভর করে শুরু হয় কবির যাত্রা এবং এই তাড়নাই তাঁকে নিয়ে যায় সৃষ্টির গন্তব্যে। কবি- শিল্পীর প্রাপ্ত প্রেরণার তার বেয়ে ভাবনার বিন্দু গুলো জমা হতে থাকে কল্পলোকের দীঘিতে। এই দিঘী, ভাবনার জলবিন্দুর সঞ্চয়, অবশেষে দিঘীতে ফোটা স্রিষ্টিকর্ম রুপ পদ্মফুল– একটি শ্রমসাধ্য পথ-পরিক্রমার ফসল। এই পথ পরিক্রমা দাবি করে অখন্ড নিরুতপাত নিরজনতা। এই নির্জনতাও আবার প্রচলিত অর্থে জনহীন নির্জনতা নয়, অনেক মানুষের ভীড়েও একান্ত ভাবনায়
নিমগ্ন কবি পেয়ে যান তাঁর নির্মাণের পথে ইতিবাচক কাংখিত ইতিবাচক নির্জনতা।
কবিরা সাধারনের মতো হননা। এই অনন্য সাধারনতা অথবা ব্যতিক্রম যাই বলা যাকনা কেন – কবির চলন-বলন, চিন্তা-চেতনা, বেশ -বাস, জীবন-বোধ, ইত্যাদি সর্ব রুপেই এঁরা থাকেন ভিন্নতর। অনু হোসেন তাঁর ‘কবিমন ও কবিতার রসায়ন’ শীর্ষক লেখায় একে অভিহিত করেছেন মুদ্রাদোষ বা ম্যানারিজম বলে। বার্ণিক রায় কবির মনোরসায়নে জারিত বোধকে অর্থাৎ দর্শন বা প্রত্যক্ষ করার পর কবির আপন বুদ্ধি-বোধ, চেতনা, জ্ঞান, সৌন্দর্য বোধ, এইসব কিছু দিয়ে কবির মনোভুমিতে নির্মিত প্রত্যক্ষকৃত বস্তুর প্রতিরুপ কে প্রতিরুপ না বলে বলেছেন কবির দেখা বস্তু বা ঘটনা বা ঘটনা সমুহের ‘মতো’। এখানে উল্লেখ করা যায় পল ভ্যালেরীর বক্তব্য টি- কবিতার এক একটি লাইন, ঈশ্বর বা প্রাকৃতিক আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে নাজেল হয়।আর বাকিটা কবিকে শেষপর্যন্ত আবিষ্কার করতে হয়। ‘উদ্ধৃত বক্তব্য টিকে দুটিকে দু’ভাগে ভাগ করেনিলে ফলাফল এমন হয়, বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার প্রথম যে ধাপটি, সেটি ইশ্বর বা প্রকৃতির আশীর্বাদে নাজেল কৃত অংশ এবং পরের যে ‘মতো ‘পর্যায়টি, সেটি কবির আপন ক্যারিশমায় আবিষ্কৃত অংশ।
পূর্ব প্রসঙ্গের রেশ ধরেই বলি, কবির যাপিত জীবন হয় ব্যতিক্রমী। প্রথাবদ্ধ জীবন যাপনকারীদের কাছে এই জেদ এই দুঃসাহস পাগলামি বলে চিহ্নিত হয়।কিন্তু স্বকীয় মত্ততা, খেয়ালীপনা, কিছু ম্যানারিজম নিয়ে আপন একান্ত ভুবনে চূড়ান্ত মনঃসংযোগ কিংবা ডুব দেয়া, যাই বলা যাক না, এর মধ্যেই চলে কবির সৃষ্টিলীলা। সৃষ্টি করতে করতে তাঁর মধ্যে আসে ম্যাচুরিটি, ডেপথ, শিল্পের কলাকৌশল প্রয়োগ, প্রয়োগের কুশলতা, বিষয়-বৈচিত্র, সমাজ সচেনতা, আরও আরও সব প্রয়োজণীয় শিল্পের ভূষণ বৈচিত্র। তারপর একসময়কবির অর্জনের ঘরে যোগ হতে থাকে সাফল্য, পরিচিতি, কখনও কখনও হয়তোবা স্বাচ্ছন্দ্যও।
এই লেখাটির জন্য অধম কল্ম ধরেছিলো মূলত এই ভাবনাটি মাথায় রেখে- ‘মেয়েরা কেন কবি হিসেবে বেশিদূর যেতে পারে না’।
চূড়ান্ত আবেগপ্রবণতা।অসম্ভব সৌন্দর্য প্রিয়তা (মানবিক সৌন্দর্য প্রিয়তা, একই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও) ভীষণ অনুভূতি প্রবনতা নিয়ে কবির জন্ম হয়! ব্যক্তিগত সামান্য পরিমাণ জ্ঞানগম্যি, পড়াশোনা নিয়ে এযাবত যা বুঝেছি, তাতে দেখেছি কবির জন্মই।
হয় কবিসত্বা নিয়ে। বাইরের চেহারায় একান্ত সাধারণ হয়েও সে থাকে অন্য দশজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্তর্গত ভাবনায়, মুগ্ধতায়, বোধে, আনন্দ বেদনার অনুভুতির স্বাতন্ত্র্যে সে থাকে আর দশজন থেকে অন্যরকম । জন্মের পর নিতান্ত শৈশবেই স্বতন্ত্র মনন চিহ্নিত কবি শিশু বিশ্বপ্রকৃতি ও পরিবেশের আপন মনেই কবিতারই অ,আ,ক,খ’র পাঠ নিতে থাকে আপন মনে। একসময় সে পায় অক্ষরজ্ঞান। অক্ষরজ্ঞান পাবার পর যেদিন সে নিজেই একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করতে পারে ও লেখার সক্ষমতা অর্জন করে, ততো দিনেই তার ভেতরে জমা হয়ে গেছে অনেকগুলো কবিতা। পারিবারিক ও আশেপাশের অনেক ঘটমান বিষয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা বিষয়ক, আপনমনেই লিখতে থাকে শিশু কবি। এসবের মধ্যে যতগুলো লেখা সে অক্ষরে, বর্ণে, শব্দে, বাক্যে রুপ দিতে সমর্থ হয় লিখিত রুপে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ তার মনের ভেতর গুঞ্জরিত হতে থাকে! অনুরনিত হয়, আপন অভিজ্ঞতা দিয়েই জানি, শিশু কবির মনের ভেতরেও কবিতা গুঞ্জরিত হয়, অনুরনিত হয়।শৈশব থেকে কৈশোর, তারপর যৌবন, এরপর?-না, কবির কোনও বার্ধক্য থাকে না! কবির আসে ক্রমাগত পরিণত হওয়ার পর্যায়,যেটাকে ম্যাচুরিটি বলে অভিহিত করা যায়।
অস্তিত্বের অতল থেকে উঠে আসা তাড়নায় কবিরচনা করেন কবিতা। পূর্বে উল্লেখিত ‘কল্পলোকের দিঘীতে ফোটা সৃষ্টিকর্মরুপী পদ্মফুল’, যেগুলো পূর্ববর্তীগুলো থেকে পরবর্তীগুলো আরো পরিনত সমৃদ্ধ হতে থাকে। যথোপযুক্ত শ্রমসাধ্য পরিচর্যার ফসল কবির পরিণত সৃষ্টি। কবিতার কৃষিক্ষেত্র, পরিচর্যা, সার দান, উৎপাদন অবশ্যই ভিন্নতর। যেই ম্যানারিজম বা মুদ্রাদোষের কথা, লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে সেটিও কবির অপরিহার্য অংগভূষণ।
নারীরা কি কবি হিসাবে ম্যানারিজমকে লালন করতে পারেন? স্ব স্ব স্বতন্ত্র ম্যানারিজমকে লালন করে নিজের অন্তরস্থিত কবিতার ক্ষেত্রকে ক্রম পরিণততর করে, বৈচিত্র্যময় ফসলের সম্ভারে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন? তাকে তো শতকরা পচানব্বইভাগ ক্ষেত্রেই অন্যদের মতোই জীববযাপনের নামে প্রথাযাপনই করে যেতে হয়। জেদ, দুঃসাহস, প্রথাভাংগার দৃঢ়তা, কবিসুলভ পাগলামিতো দূরের কথা রাতজেগে লেখার স্বাধীনতা টুকুও নারীর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাকে না। বিরক্ত পতিদেবতার ভ্রুকুটি যদিবা নাও থাকে, ভোরবেলা উঠে সংসারের চাকাটি স্টার্ট দেবার গুরু দায়িত্বটা ও যে সর্বদা নারীরই থাকে! বিনিদ্র রাত্রিযাপন শেষে পুনরায় দিবসযাপন- এভাবে দু’চারদিন চললে ফলস্বরুপ নিজ অসুস্থতায়।
অন্যদের সুখ সুবিধার অন্যথা, নারীর কবিতাকে বেশিদিন বেশিদূর কবিতার পথে যাত্রা ব্যাহত করে।
স্বকীয় মত্ততা, তাতে চূড়ান্ত মনঃসংযোগ – এ দুটি অপরিহার্য ক্রিয়া, যা ব্যতীত কাব্যসৃষ্টি অসম্ভব- তার কোন ও সুযোগই কী নারীর জীবনে থাকে? অথচ যিনি কবি তাঁর তো এ ছাড়া চলবেই না। বাধাতো শুধু সামাজিকই নয়, তার নিজের ভেতরেও অনেক। তবে যেটাকে নিজের ভেতরকার বাধা বলে মনে হয়, সেটিও সামাজিক অনুশাসনেরই উতপাদন। বেশ কিছুদিন আগে অকাল্প্রয়াত একজন কবি আপন মাহমুদ দৈনিক ‘সমকাল’ পত্রিকার সাপ্তাহিক শুক্রবারের সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় তাঁর ঢাকায় এসে প্রথম দিককার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের যে কাহিনি লিখেছিলেন- একটি অত্যন্ত কঠিন যুদ্ধের চিত্র। কিন্তু সেটা একই সাথে কবিতার জন্য শতভাগ ইতিবাচক। একজন নারীর বস্তিতে, পার্কে, গাছতলায় খেয়ে না খেয়ে এভাবে থাকা অসম্ভব। জীবনকে সবগুলো বোধে জারিত করে দেখার সুযোগে আপন মাহমুদের ঘটেছিলো উপলব্ধির উৎকর্ষতা। সবার ওপরে বড় শ্ত্রুতা করে নিরন্তর নারীর নিজের শরীর। “অপণা মাংসে হরিণা বৈরী! “ইদানীং কালেতো নারী ষাট কিংবা সত্তুরের দশকের সময়ের চেয়েও আরও অনেকগুন ভয়ংকর রুপে অনিরাপদ সবকিছু।
মিলিয়েই কুসুমকুমারী দাশ, শ্রদ্ধাভাজণীয়া সুফিয়া কামাল এবং (যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক) আর ও অন্যান্যদের পর আধুনিক এবং উত্তর আধুনিকে কবিতাংগনে উপস্থিত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু একেবারেই অনিয়মিত। যারা অবস্থান করছেন তাঁরাও কেমন যেন নিষ্প্রভ।প্রেমের একধরনের ফুলেল ফাল্গুনী রুপ আর বিরহের অশ্রুসিক্ত প্রেমী কাতরতা, নচেৎ জন্মভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরঅস্তিত্বের অতল থেকে উঠে আসা তাড়নায় কবিরচনা করেন কবিতা। পূর্বে উল্লেখিত ‘কল্পলোকের দিঘীতে ফোটা সৃষ্টিকর্ম রুপী পদ্মফুল ‘, যেগুলো পূর্ববর্তী গুলো থেকে পরবর্তী গুলো আরো পরিনত সমৃদ্ধ হতে থাকে।যথোপযুক্ত শ্রমসাধ্য পরিচর্যার ফসল কবির পরিণত সৃষ্টি। কবিতার কৃষিক্ষেত্র ,পরিচর্যা, সার দান, উৎপাদন অবশ্যই ভিন্নতর। যেই ম্যানারিজম বা মুদ্রাদোষের কথা, লেখার শুরুতে ই বলা হয়েছে সেটিও কবির অপরিহার্য অংগভূষণ।
নারীরা কি কবি হিসাবে ম্যানারিজমকে লালন করতে পারেন? স্ব স্ব স্বতন্ত্র ম্যানারিজমকে লালন করে নিজের অন্তরস্থিত কবিতার ক্ষেত্রকে ক্রম পরিণততর করে, বৈচিত্র্যময় ফসলের সম্ভারে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন? তাকে তো শতকরা পচানব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই অন্যদের মতোই জীববযাপনের নামে প্রথাযাপনই করে যেতে হয়।জেদ, দুঃসাহস ,প্রথভাংগার দৃঢ়তা ,কবিসুলভ পাগলামিতো দূরের কথা রাতজেগে লেখার স্বাধীনতা টুকুও নারীর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাকেনা।বিরক্ত পতিদেবতার ভ্রুকুটি যদিবা নাও থাকে,ভোরবেলা উঠে সংসারের চাকাটি স্টার্ট দেবার গুরু দায়িত্বটা ও যে সর্বদা নারীরই থাকে! বিনিদ্র রাত্রিযাপন শেষে পুনরায় দিবসযাপন- এভাবে দু চারদিন চললে ফলস্বরুপ নিজ অসুস্থতায়।
অন্যদের সুখ সুবিধার অন্যথা, নারীর কবিতাকে বেশিদিন বেশিদূর কবিতার পথে যাত্রা ব্যাহত করে।
স্বকীয় মত্ততা ,তাতে চূড়ান্ত মনঃসংযোগ – এ দুটি অপরিহার্য ক্রিয়া ,যা ব্যতীত কাব্যসৃষ্টি অসম্ভব- তার কোন ও সুযোগই কী নারীর জীবনে থাকে? অথচ যিনি কবি তাঁর তো এ ছাড়া চলবেই না। বাধা তো শুধু সামাজিকই নয়,তার নিজের ভেতরেও অনেক। তবে যেটাকে নিজের ভেতরকার বাধা বলে মনে হয়, সেটিও সামাজিক অনুশাসনেরই উতপাদন। বেশ কিছুদিন আগে অকাল্প্রয়াত একজন কবি আপন মাহমুদ দৈনিক ‘সমকাল’ পত্রিকার সাপ্তাহিক শুক্রবারের সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় তাঁর ঢাকায় এসে প্রথম দিককার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের যে কাহিনি লিখেছিলেন- একটি অত্যন্ত কঠিন যুদ্ধের চিত্র। কিন্তু সেটা একই সাথে কবিতার জন্য শতভাগ ইতিবাচক।একজন নারীর বস্তিতে, পার্কে, গাছতলায় খেয়ে না খেয়ে এভাবে থাকা অসম্ভব।জীবনকে সবগুলো বোধে জারিত করে দেখার সুযোগে আপন মাহমুদের ঘটেছিলো উপলব্ধির উৎকর্ষতা। সবার ওপরে বড় শ্ত্রুতা করে নিরন্তর নারীর নিজের শরীর। “অপণা মাংসে হরিণা বৈরী! ইদানীং কালেতো নারী ষাট কিংবা সত্তুরের দশকের সময়ের চেয়েও আরও অনেকগুন ভয়ংকররুপে অনিরাপদ সবকিছু।
মিলিয়েই কুসুমকুমারী দাশ, শ্রদ্ধাভাজণীয়া সুফিয়া কামাল এবং (যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক) আর ও অন্যান্যদের পর আধুনিক এবং উত্তর আধুনিকে কবিতাংগনে উপস্থিত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু একেবারেই অনিয়মিত। যারা অবস্থান করছেন তাঁরাও কেমন যেন নিষ্প্রভ।প্রেমের একধরনের ফুলেল ফাল্গুনী রুপ আর বিরহের অশ্রুসিক্ত প্রেমী কাতরতা, নচেৎ জন্মভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণ … এসব ছাড়িয়ে আর কোনো বৈচিত্র ধারন করেনা নারীদের কবিতা (বাংলাদেশ)। ব্যতিক্রমী দু’চারজন হয়তো আছেন- কিন্তু ব্যতিক্রম কখন ও উদাহরন হয়না।মাঝে এলেন চূড়ান্ত খোলামেলা সাহসী বক্তব্য দিয়ে ম্যানারিজমএর চূড়ান্ত দেখালেন তসলিমা নাসরিন।
কিছু অনবদ্য কাব্য পঙক্তি মালা পাঠক পেলো। কিন্তু তসলিমা নাসরিন এর সেসব অনবদ্য পংক্তি মালায় নারীজন্মের কষ্ট, অবমাননার চিত্র ,তা থেকে মুক্তির আকুতি যতখানি না ধারন করেছে তার চেয়ে বেশি পাঠকের কাছে গৃহীত হয়েছে পর্ণগ্রাফি হিসেবেই, বেষ্টসেলার হয়েছে।তবে তাঁর নির্বাচিত কলামে বরং অনেক স্থির, এবং সচেষ্ট ছিলেন সমস্যার মর্মমূলে প্রবেশ করতে। তাঁর খোলামেলা সাহসী বক্তব্যে নারী পাঠককুল অনেকখানি আশান্বিত হয়েছিলেন-আর বোধহয়।
তাঁদের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত পংক্তিটি ভাবতে হবেনা-“ কত পাপ করেছিনু, হয়েছিনু নারী”।সব মিলিয়ে তসলিমা নাসরীন বিশ্বখ্যাত সেলিব্রিটি হলেন, কিন্তু যে অধ্যায় তার কথিত নারীবাদ নিয়ে কাজ করার ছিল, সেটি হলোনা। ঘুরে চলে গ্যালো অন্য অধ্যায়ে। তসলিমা নাসরীনের নিরাভরন সরল বক্তব্য প্রধান কবিতাগুলো এখন আর চোখে পড়েনা। মোটকথা প্রতি বাদী নারী কবি হিসেবে তিনিও রইলেননা সবরকমের প্রতিকূলতা, সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনুশাসন এসব নিয়ে যতোটা তিনি বলেছিলেন, তার চেয়ে বেশি বলেছিলেন জরায়ুর স্বাধীনতার কথা। তার প্রাথমিক আগমনের পর নারী পুরুষ নির্বিশেষে তরুণসমাজ আনন্দিত ও আশাবাদী হয়েছিলো- বাংলা কবিতায় একটি নতুন দিগন্তের ঊন্মেষ ঘটতে যাচ্ছে।কিন্তু না, শুধুই কিছু খোলামেলা, সাহসী (?) বক্তব্য দিয়ে এটিও অন্য অধ্যায়ে ঘুরে চলে গেলো! কবি হয়ে থাকলেননা তসলিমা নাসরীন!
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত আর ও একটি ব্যপার মাথায় আসে,এত সবের পর ও লিখতে থাকেন অনেকেই। কিন্তু লেখা প্রকাশ করবার ব্যাপারে ও তো অন্তরায় কম নয়, এমনিতেই কবিরা হন অন্তর্মুখী । তার ওপরে নারীর সহজাত অন্তমুখীনতা এবং সহজাত প্রকাশ বিমুখতায় আত্মপ্রকাশের আলোক আর তার কবিতার ভূবনে ঘটেনা। নারীর লেখা কবিতাগুলো অনেকক্ষেত্রেই লুকিয়ে রাখা থাকতে থাকতে হাড়িচাপা ঘাসের মতোই বিবর্ণ ফ্যাকাসে হতে হতে ক্রমশ মরে যেতে থাকে।প্রায়শই দেখা যায় তার এমন কোন ও শুভার্থী বন্ধু সুহ্রদ ও থাকেনা যে তাকে না জানিয়ে তার কবিতাগুলো ছেপে দিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেবে!এ৪সব বুঝিবা গল্পে উপন্যাসেই ঘটে থাকে, বাস্তবে নয়! সময়ে অসময়ে যথেচ্ছ প্রলম্বিত সাহিত্য আলোচনা নির্ভর আড্ডা গুলো থেকেও এইসব গুপ্ত, নবীশ কবিরা থাকে বঞ্চিত।অথচ এই আড্ডা গুলো কাব্য সৃষ্টি এবং উৎকর্ষ বৈচিত্র্য এর জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় জৈব সার এর মতো। নারীর কবি হিসেবে বেশিদূর যেতে না পারার অ-নেক গুলো কারন আমার মতো অভাজন এর জানামতো আছে। হয়তো সুধী প্রাজ্ঞ জন আমার মতামতের শতভাগ অসারতা যুক্তিসহকারে বের ও করে ফেলতে পারবেন।তবে অন্তিমে এসে আমার প্রিয়, শ্রদ্ধেয়, মান্যবর ব্যাক্তিত্ব অধ্যাপক জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর একটি কথা এই মূহ্রতে মনে পড়ছে ২০০২ এ শিল্প সাহিত্যের ছোটকাগজ “প্রজ্ঞা’র জন্য তিনি আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এই প্রসংগ তি উঠলে তিনি বললেন-আপনি করতে পারছেননা, কারণ আপনি করতে চাইছেন না। যখন আপনি চাইবেন, তখন আপনি ঠিকই।
করতে পারবেন। ঠিক সে সময় আমার কাছে কথাটি একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু ওই কথাটিকে মাথায় নিয়েই আমি ২০১৩ থেকে এই ২০২২ পর্যন্ত বলতে গেলে সম্পূর্ণ একা একাই তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং তিনটি গদ্গ্রন্থ প্রকাশ করে ফেলেছি। এখন আমা্র মস্তিস্কের ভেতর এই বিদগ্ধ চারুবাক মানুষটির ওই কথাটি একটি অমূল্য বাণীরুপে প্রোথিত আছে! তবে সবশেষে একটি কথাই বলবো। পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সেই শ্রম, শারীরিক ও মানসিক দুরকমই হতে পারে। এই শ্রমে আপনার পারিপারশ্বিকতা (ঘর, বাহির দুই’ই) আপনার অনুকুলে আসতে বাধ্য, এতে আপনি সমৃদ্ধ হবেন।কবিতা নির্মাণে আপনি হবেন বাধাহীন জয়িতা।মন প্রাণ দিয়ে চাই তীব্র মধ্যহ্নে পায়ের নিচে পীচ গলা রোদের উত্তাপ,বুভুক্ষ কংকালসার মানবাধিকার বঞ্চিত মানুষ, ন্যায়বিচার বঞ্চিত নারীদের অধিকারের দাবীতে সোচ্চার কাব্য নিয়ে শাণিত কলমে লিখে যাচ্ছেন কবি জয়িতা নারী।
৫ Comments
অসাধারণ উপস্থাপন
congratulations
শাবাস! যদিও কথাগুলো আর একটু গুছিয়ে বলতে পারলে লেখাখানি গভীরগ্রাহী হোতো
তবুও লিখেছেন সরাসরি সারকথা” বলা যায় সাবস্ট্যন্স। আমি তাঁকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই তার এই শ্রমসাধ্য প্রবন্ধ নারী লেখকদেরকে উপহার দেবার জন্য।
নারী লেখায় বেশিদুর এগোতে না পারার যে কারণগুলো তিনি দেখিয়েছেন তা আ- বহমান কাল থেকেই আছে, ছিলো, থাকবে। কিন্তু চিরদিন ইচ্ছার প্রাবল্য আর সৃষ্টির উপলব্ধি সকল বাঁধকে ভেঙেছে।তার প্রমান নারী মুক্তির অগ্রদূত সাহিত্যিক মহীয়ষী বেগম রোকেয়া নারী সাংবাদকতার পথিকৃত বেগম নূরজাহান, কবি বেগম সুফিয়া কামাল সেলিনা বেগম, থ্রিলার লেখক রোমেনা আফাজপ্রমুখ। নারী ঔপন্যাসিকও এ জামানায় বহুত আছেন।
শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদের উক্তিখানাই জোরালো হয়ে রইলো। এবং এটাই সত্য। পরিশ্রম আর সাধনার পাশাপাশি ঐষিক একটা বিষয় কাজ করে তবে তা হতে হবে বস্তুনীষ্ঠ এবং মানব কল্যাণে ব্রতী। তা নাহলে সারাদিন গাঁজা সেবন করে হজবরল লেখার সৃষ্টি হবে।
এগোনো দূরঅস্ত। নাস্তিক্য অমৌলিকত্ব, অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ এবং বাক ভীরুতা লেখকের সৃষ্টির অন্তরায় হয়েছে হচ্ছে, হবে।
আবারও এ তরুণী সাধুবাদ জানাই খুব সময়োপযোগী একখানা চমৎকার প্রবন্ধ উপহার দেবার জন্য।
সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপুর্ন প্রবন্ধটি পড়ে ভালো লাগলো।লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।
‘জীববযাপনের নামে প্রথাযাপনই করে যেতে হয়’ হ্যাঁ প্রসঙ্গের বিস্তার যত যা যাক সেটুক যাপন করেই যাবে । অনুক্তেও উক্ত হয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতার কথা।
কবিচিত্তের ভেতরবাড়ীতে কত কি ঘটে অহরহ, যেখানে একলার রাজত্ব কবির ! প্রথাযাপন করা জীবন থেকে সে আলাদা জগত । বোধনের এমন দূ-কুল মিশেল শুধু কবি মাত্রের ই বিশেষ প্রাপ্তি নিশ্চয় । কবি কে? কবি কাকে বলবো? সে স্তবকগুলি পড়ে বললাম ।
খুব ভালো লেগেছে লেখাটা । শুভকামনা কবি আখতার শেলী