২০১ বার পড়া হয়েছে
কন্যাদায়
[ ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান ]
মেয়ের বাবা হয়ে মহাবিপদে পড়েছেন ইকরাম সাহেব। বিপদে পড়াটাই স্বাভাবিক। অষ্টাদশী শিক্ষিত রূপবতী মেয়ের বাবা। প্রতিদিন ঘটকরা এসে ঘোরঘোর করে বিভিন্ন পাত্রের ছবি আর বায়োডাটা নিয়ে। তিনি যতই বলেন, এখনই মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন না। নাছোড়বান্দা ঘটকরা তার পিছু ছাড়ছে না। একটার পর একটা পান চিবিয়ে মিষ্টিমুখে বলবে, অমুক ছেলে শিক্ষিত সুদর্শন। তমুক পাত্র বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। এই ছেলের চৌদ্দগোষ্ঠি লন্ডন আমেরিকায়। সেই ছেলে বড় চাকুরী করে। এমন ভালো-ভালো পাত্রের ঢাকঢোল প্রায়ই পিটিয়ে যায় ঘটকবাহিনী।
ঘটকবাহিনীর ঢাকঢোল ইকরাম সাহেব কানে ঠাঁই না দিলেও অন্তরি বেগমের কান ঠিকই ভারী করে তুলেছে। ভারী হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেয়ের মা বলে কথা। খুব সাদামনের মহিলা। মানুষের প্রতি ভালোবাসার সাগর। ঘটকদের তুষ্ট রাখতে যাতায়াত খরচ আর চা পানের টাকাটাও ঠিকভাবে মিঠলো কিনা খেয়াল রাখেন তিনি। কথায় আছে ‘দয়ায় আপদ বাড়ে।’ বেশি দয়ালু হওয়ায় আপদবিপদেরও শেষ নেই। কোনো ভিক্ষুক দরজায় এলে টাকা বা চাল-ডাল তো দেবেনই। পেট ভরিয়ে ভাত খাইয়ে দিতেও ভুলেননি। তাই দরজার সামনে ভিক্ষুকের ঝামেলাও কম পোয়াতে হয় না। অতিথি এলে তো কথাই নেই। আদরের অন্ত থাকে না অন্তরি বেগমের।
অন্তরি বেগমের কাছে ঘটকরাও একেকজন মহান অতিথি হিসেবে গণ্য। একমাত্র মেয়ের জন্য ভালো-ভালো পাত্র খুঁজছেন যারা তাদের মন তো খুশি রাখতেই হবে।
রাতের বেলা। শোবার ঘরে। নরমস্বরে ইকরাম সাহেবের সাথে অন্তরি বেগমের আলাপ,
:ওগো, ঘটকরা এত কষ্ট করে আমাদের একমাত্র মেয়ের জন্য এতগুলো ভালো ছেলের সন্ধান দিচ্ছে। তোমার কি একটি ছেলেও পছন্দ হয়নি?
: হয় অন্তরি, হয়।
: তাহলে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছো না কেন?
: মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছো কেন বলো তো? মেয়েটা আরো কিছু পড়াশোনা করুক না।
: এত পড়াশোনা দিয়ে কী হবে শুনি? মেয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে মাস্টারি করবে নাকি?
: মাস্টারি না করলেও ডেগমাস্টারি তো করবে।
: মেয়েমানুষ বলে কথা। স্বামীর ঘরে গিয়ে ডেগমাস্টারি তো করতেই হবে। এর জন্য কি মেয়ের বিয়ে দেবো না?
: দেবো গো দেবো। এর জন্যই আরোকিছু পড়াশোনার দরকার।
: কীজানি বাবা! তোমার সবকথাতেই ইয়ার্কি অবহেলা! এসব শুনতে ভাল্লাগে না আমার!
: একটু বোঝার চেষ্টা করো অন্তরি। বাচ্ছামেয়ে। সংসারের কী বোঝে সে? পড়াশোনা করলে বুদ্ধি বাড়বে। শারীরিক পরিপক্বতা আসবে। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবার সাথে মানিয়ে চলার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু বাড়ুক না মেয়েটার। রান্নাবান্নার কিছু তালিম দাও ওকে। আদর দিয়ে তো কোনোদিন চুলোর কাছেই যেতে দাওনি।
: আমাকে দোষ দিচ্ছো? তোমার আদরের চাক্কা মেয়ে কি চুলোর কাছে যায়? তুমি ওকে কোনোদিন কোনো কাজ করতে দিয়েছো?
: এবার ওকে রান্নাঘরে নাও। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রান্নাবাড়া করতে হবে না? রান্নাবান্না হচ্ছে একটা শিল্প। বিশেষ করে মেয়েদেরকে সেটা জানতেই হবে।
: আচ্ছা বাবা! ঠিক আছে। আমি ওকে সব শিখিয়ে নেব। এবার বলো, তুমি মেয়েটার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করবে?
: হ্যাঁ, করব। তোমাকে নিয়েই করব। এবার এককাপ কড়া লিকারের চা দাও তো।
: এতরাতে চা খাবে তুমি? তুমি তো রাতে চা খাও না। রাতে চা খেলে তোমার ঘুম হয় না।
: আজ খাব। খুব মাথা ধরেছে।
: ঠিক আছে আমি তোমার জন্য চা করতে যাচ্ছি।
ইকরাম সাহেবের ঘুম হয়নি সারারাত। মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবনার পাহাড় চেপে বসেছে মাথায়। অতি আদরের একমাত্র মেয়ে শ্বশুরালয়ে চলে যাবে? কোন ঘরে যাবে? কী আদর পাবে? ছেলেটি কেমন হবে? শ্বশুর-শ্বাশুরি নিজের মেয়ের মতন দেখবে কী? বড় অংকের টাকা আর বড় বাড়ি থাকলেই কি সবার মন বড় হয়? ভাবনা আর ভাবনা…! ভাবনার সাগরে সারারাত হাবুডুবু খেলেন তিনি। মেয়ের বিয়ে, এবং ভালো নিয়ে ভাবতে-ভাবতে ফজরের আজান হয়ে গেল। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠ, আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম…। ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম। ঘুম তো হলোই না। ধীরে-ধীরে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলেন।
নামাজ শেষে বাসায় এলেন। কোরান তিলাওয়াতে বসবেন। বারান্দায় বসে মেয়েকে ডাকছেন, সুরাইয়া… সুরাইয়া মা…। চোখ কচলিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সুরাইয়ার জবাব,
: জ্বি বাবা।
: ঘুম থেকে ওঠো মা। ফজরের নামাজ পড়তে হবে না?
: উঠছি বাবা।
: ওজু করে নামাজ পড়ে নাও।
: আচ্ছা বাবা।
: আজ তোমার হাতের চা খাব মা।
: দিচ্ছি বাবা। আমি নামাজ সেরে তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।
সুরাইয়া চুলোয় চায়ের পানি চাপিয়ে ওজু করে নামাজ সেরে নেয়। বাবার জন্য চা নিয়ে যায়। বাবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে, মিষ্টি হেসে বললেন, মা আমার পাক্কা রাঁধুনি হয়ে গেছে। মাথাটায় হাত বুলিয়ে দে মা। রাতে ঘুম হয়নি। সুরাইয়া বাবার পিঠঘেষে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এটা তার অভ্যাস। সবসময় করে। বাবার কাছে গেলেই মাথায় হাত বুলাবে। পাকাচুল ছিঁড়বে। মাথা চুলকিয়ে দেবে। বাবা ভারী গলায় সুরাইয়াকে বলছেন, তোর মা তো তোকে বিয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তোর মতামত কীরে মা?
বাবার মুখে এমন কথা শুনে সুরাইয়ার চোখেমুখে লজ্জা, খুশি, লজ্জা আর রাগের মিশ্রণ ফুটে ওঠে। সকালের সূর্য কেবল উঁকি দিতে যাচ্ছে। সূর্যের চেয়েও লাল দেখাচ্ছে সুরাইয়াকে। লজ্জায় লাল। রাগে লাল। খুশিতে লাল। বাবার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে, কোন মেয়ে লজ্জা না পায়? সুরাইয়ার লাজুক মুখের কাছে যেন সকালের শিশিরস্নাত লজ্জাবতীও হার মানবে। খুশির কাছে যেন সূর্যের হাসিও মলিন দেখাচ্ছে।
বাবার মাথায় হাত বুলাতে আঙুল কাঁপছিল। বাবা সুরাইয়ার মুখের দিকে না তাকালেও বুঝতে পারছিলেন, ওর মনের অবস্থা কেমন হবে? বাবা আবার বললেন, কিছু বল মা। সুরাইয়া হালকা রাগের স্বরে বলল,
: তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো বাবা? আমি তোমাদের উপর বোঝা হয়ে গেছি?
: নারে মা। এভাবে বলছিস কেন? সব মেয়েরাই স্বামীর ঘরে যায়। তুইও যাবে। এটাই তো নিয়ম রে মা।
: তুমি না স্বপ্ন দেখতে বাবা! আমি পড়াশোনা করে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াব। তারপর আমার সংসার নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। এসব ভুলে গেছো বাবা?
: ভুলিনিরে মা। ভুলিনি। আর ভুলিনি বলেই আজ তোকে নিয়ে আমার এত ভাবনা। তোর মায়ের এত ভাবনা।
: কিসের এত ভাবনা শুনি? আমি কি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি?
: নারে মা। আমি তো বলি, তোর এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি।
: তাহলে কেন মিছেমিছি এত ভাবছো? আর ভেবে-ভেবে নিজের শরীরটা খারাপ করছো?
: এই শরীরটার জন্যই এত ভাবছি মা। আমার বয়স হয়েছে। বুঝতে পারছি বেশিদিন বাঁচব না। কখন কী হয়ে যায় খোদাই জানেন।
: প্লিজ বাবা! এসব বলো না! সুরাইয়া বাবার ঠোঁট চেপে ধরে।
: বেঁচে থাকতে তোকে একটা ভালো পাত্রস্থ করতে পারলে আমার ভালো লাগবে মা। প্রয়োজনে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাকি পড়াশোনাটা সেড়ে নেবে। আমি যে ছেলেকেই পছন্দ করি না কেন তোর পড়াশোনার বিষয়ে এই আবদারটা রাখব। তবে একটাই চিন্তা, জগতে মানুষ চেনা খুব কঠিন। বেশিরভাগ মানুষই মুখোশের আড়ালে আসল মুখটা ঢেকে রাখে। ভাবছি, বাবা হয়ে নিজের মেয়ের জন্য দুর্গতি ডেকে আনছি না তো? এই কথাটি তোর মাকে বোঝাতে পারছি না। সে সহজ সরল বলে, সব মানুষকে সহজ সরল ভাবে। এর জন্য তাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। খুব ভালো মানুষ সে। তোর ভালো চায়। এসব মানুষ কষ্টকেও সহজে মেনে নেয়। কিন্তু আমি তা পারব না মা। তুই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব। তোর কোনো কষ্ট সহ্য করতে পারব না।
: বাবা তুমি ভালো থাকো। তুমি ভালো থাকলে, মা ভালো থাকলে, আমিও ভালো থাকব। আমি গেলাম বাবা।
: তোর মাকে একটু ডেকে দে মা। আমার জন্য তোর মাও ঘুমোয়নি রাতে। তাই ডাকিনি।
বাবার মনোবীণায় নীরবে একটি গান বাজতে থাকে
‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়
বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়
মুখঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায়
মানুষকে কি করে চিনবে বলো…’
—————————— ———-
ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান
ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক
সিলেট।