১৭৭ বার পড়া হয়েছে
নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। সাংবাদিকতা ছেড়ে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত একজন কর্মী।
সেসময় তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন। মঈনুল আহসান সাবের ও তসলিমা নাসরিনও জনপ্রিয়তার কাতারে। কবিতায় জনপ্রিয় নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা। এরপর রফিক আজাদ ও হেলাল হাফিজ।
বইমেলা মানেই উল্লেখিত লেখকদের বই নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা। বুলবুল চৌধুরী জনপ্রিয় লেখকদের কাতারে নেই। কিন্তু তাঁর ‘টুকাকাহিনি’ গল্পগ্রন্থ বোদ্ধাপাঠকদের মন কেড়ে নিয়েছে। টুকাকাহিনি পড়ে বুলবুল চৌধুরীর ভক্ত হয়ে গেলাম। লেখককে দেখার জন্য মন ইতিউতি করতে শুরু করল। একদিন বুলবুল চৌধুরীর সাথে দেখা হয়ে গেল বাংলাবাজারেই। এবং পরিচয়। বুলবুল চৌধুরী হয়ে গেলেন প্রিয় বুলবুল ভাই।
সেই থেকে কত দিবস-রজনী আড্ডা, গল্পসল্প, ভ্রমণ করেছি একসাথে। তাঁর হিসেব নেই। পরিচয়ের শুরুর দিকের গল্প ‘এক বিকেলে আড্ডার গল্প’। সময়ের হিসেবে লেখাটির বয়স কমপক্ষে পঁচিশ বছর।
গতকাল বুলবুল ভাই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। পুরনো লেখার আস্তানা থেকে ‘এক বিকেলে আড্ডার গল্প’ বের করে পোস্ট দিলাম।
#
এক বিকেলে আড্ডার গল্প
হুমায়ূন কবীর ঢালী
[গল্পটি কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরীকে নিবেদিত]
#
পুরনো ঢাকার চেনাজানা একটি গলি। সুত্রাপুর বাজার থেকে ডালপট্টির মোড়ে গিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে বাংলাবাজারের দিকে এক মিনিট হাঁটলেই একরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার ঠিক উল্টো দিকের রাস্তা।
রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে জোরেসোরে। দায়িত্ব পালন করছে সিটি কর্পোরেশন। ভেজা মাটি। ইটের ভাঙা টুকরো, কাঁকর। পুরনো স্যান্ডেলের খয়ে যাওয়া তল ভারি করে দু’পাশের দেয়ালের উদার সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া। দেড় মিনিটের পথ এগোতে দশ মিনিট ব্যয় করে বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে হাজির হলাম।
পুরনো আমলের বাড়ি। দোতলা। চওড়া বাউন্ডারি দেয়াল। লালমাটির পলেস্তারায় আটকানো। দু’একটা ক্ষয়িঞ্চু বয়সি ইট বেরিয়ে এসে বয়স জানান দিচ্ছে। দুই পাশের দেয়ালের মধ্যমণি হয়ে কাঠের দরজা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা।
দরজায় কলিংবেলের সুইচ। চাপ দিতেই ভেতরে বেল বাজার শব্দ কানে পৌঁছল। তড়তড় করে একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। গায়ে ঢিলেঢালা সেন্টুগেঞ্জি, হাফপ্যান্ট পরা। চোখে ভাড়ি চশমা। দরজার কাছে এসে দৃষ্টিতে বলল, কি চাই?
আমি তাঁর কথা বলি। ভাই বলে সম্বোধন করি যাকে। আমার শ্রদ্ধাভাজন। প্রিয় ব্যক্তি। প্রিয় মানুষ। যার লেখা পড়ি মনযোগ দিয়ে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। কিশোর ছেলেটি জানালো ভাই বাসায় আছেন। কিন্তু আমি ভেতরে প্রবেশ করব, নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব, কোনো সমাধান না দিয়ে ছেলেটি একপ্রকার বিরক্তির ভাব দেখিয়ে ভেতরে চলে যায়।
আমি তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকি পুরনো বাড়িটির দিকে। দোতলার বারান্দায় আমার অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ। ভেতরে যাওয়ায় আহবান শোনার প্রত্যাশায় বাড়ির ।
একটু পরে উপর থেকে, উপর মানে দোতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে অন্য একটি ছেলে ডাক দেয়, আঙ্কেল ভেতরে আসেন।
আমার বুঝতে বাকি থাকে না, এই ছেলেটি, মানে সতের-আঠারো বয়সের যে ছেলেটি উপর থেকে, মানে একতলার ছাদে দাঁড়িয়ে আমাকে আমার প্রিয় মানুষের খবরটি দিয়ে গেল, ও তাঁরই সন্তান। ছেলেটির চেহারায় ভাইয়ের আদল। যদ্দুর জানি ভাইয়ের বড় ছেলে কলেজে পড়ছে। মেঝো ছেলে সভেনে।
নির্দ্বিধায় বাড়ির ভেতরে ঢুকে পাকা স্যাঁতস্যাঁতে উঠোন মাড়িয়ে সিড়ি ভেঙে দোতলায় উঠি।
ছেলেটির নির্দেশ মতো বাড়ির পূর্ব দিকের একটি রুমে গিয়ে বসি। সম্ভবত এটি ড্রয়িরুম। পরিপাটি। বেতের সোফা। টি-টেবিল। টেবিলে শুয়ে আছে কয়েকটি বাংলা ম্যাগাজিন। রুমের একপাশে বইয়ের আলমেরি। ছোটবড় নানারকম বইয়ে তাক ভর্তি। লেখকের রুম বলে কথা। রুমে বইপত্রের আধিক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, মানিক, শরৎচন্দ্র উঁকি দিয়ে আছেন আলমেরি থেকে।
একটু পর তিনি এলেন। তিনি মানে লেখক বুলবুল চৌধুরী। আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। পিঠে হাত রেখে সাদরে এবং আদরে।
আইস্যা পড়লাম ভাই। আমি বলি।
ভালো ভালো ভালো…। খুউব ভাল হইছে। চলতি আর আঞ্চলিক ভাষার মিশেলে অবনীল চৌধুরী কথা বলেন।
তিনি আমাকে তাঁর খাস কামরায় নিয়ে বসালেন। রুমের পরিবেশ তাঁর মতোই। আমি যে চেয়ারটিতে বসলাম, আমার সামনে, বরাবর একটা বড় বুকসেলফ। এইরুমেও বইয়ে ঠাসা, বিখ্যাত-অখ্যাত সব বই। বাঁ-পাশে একটা কম্পিউটার অন করা। একটা মেয়ে অপারেটর, দেখতে সুন্দরী বলা যায়, যুবতী, নাদুস-নুদুস, রোমান্টিক, বোকা চাহনি, মিষ্টি মুখ। ডানপাশে বুক সেলফ আরেকটি, তার আগে খাটিয়া এটাই সম্ভবত তাঁর শোবার ঘর-কাম সবকিছু। তিনি লেখেন। রবীবাবুর মতো জমিদারী নেই তাঁর। হালের দামি লেখকদের মতো ব্যাংক ব্যালেন্স নেই কোটি কোটি টাকা। রোজ আপেল-আঙুর নিয়ে প্রকাশক, তোষামোদকারীরা আসেন না। তাই এই একমাত্র ঘরটিই তাঁর জন্য যথেষ্ট। তবুও তিনি সন্তুষ্ট।
কি খাইবেন? অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন তিনি।
না, না কিচ্ছু খামু না।
চা তো খাইবেন। চা খাইতেই অইব। আপনার উছিলায় আমরাও একটু… বিস্কুট খাইবেন, তোস্ট বিস্কুট…ভালো… এই এহানে বিস্কুট দেও তো। বউকে বললেন।
তাঁর আপ্যায়নে এতোটাই আন্তরিকতা, শিশুর মতো, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও না খেয়ে পারলাম না। তিনিও চা খেলেন। খেতে খেতে বললেন অনেক কথা। অনেক ব্যথা ঝরে পড়ে সে কথায়।
টিভিতে আর নাটক লিখবো না। একেবারেই না। গত নাটকটা, চন্দ্রগ্রহণ। শুধু জাকির সাহেবের জন্যেই হয়েছে। বুঝলেন, ধান্ধা… সবখানেই ধান্ধা। সাগরকে ফোন করছি চ্যানেলে অনুষ্ঠান করমু। সম্মান থাকবে। ওরা চায়। আমারে চায়। ছোটদের জন্যে কিছু করতে চাই। কিছু করতে হবে। আমাদের শিশুরা ভালো কিছু পাইতাছে না। আমরা না দিলে ওরা পাইব কই। লিখেন লিখেন, ছোটদের জন্যে লিখেন। এই যে মাইয়াডা দেখতাছেন, ভালো মাইয়া। প্রতিবেশি। আমার লেখাটেখা কম্পোজ করে দেয়। বিয়া হয় নাই মিয়া। একটা ছেলে দেইখেন। লেখাপড়া কইরা বইসা রইছে। চাকরি পাইতাছে না। চাকরি, বিয়া দুইটাই দরকার।
কী কও টিয়াপাখি, ঠিক বলছি না? মেয়েটিকে বলল। মেয়েটি কোনো জবাব দেয় না। তবে লাজুক চাহনীতে তার কথায় সায় দেয়।
বুলবুল চৌধুরী আবার বলতে শুরু করেন, আমার এক বন্ধু আছে। ও বলেছে একটা প্রোডাকশন করবো। সিনেমা বানাইব। কীসের সব মিছা কথা। আমাদেরই করতে হবে এসব। আমাদেরই করতে হবে। ধ্রুবও একটা নাটক না সিনেমা বানাইব। কইল ত। জানি না, কী করব, ক্যামনে করব, কিচ্ছুই বুঝি না। ওদের আশায় থাকলে চলবো না। একটা শিশুদের পত্রিকা করবো। লিখবেন। আপনার লেখাটেখা ভালো লাগে। আরও দেবেন, পড়বো। দেবেন কিন্তু। এই তুমি কম্পোজ করতে থাকো। অপারেটর মেয়েটিকে তাড়া দেয় কথার ফাঁকে।
পঞ্চাশ ফর্মার একটা বিশাল কাজ হাতে নিয়েছি। বুঝতে পারছি লেখা ছাড়া গতি নাই। আর কিছু ত জানি না। লেখাটাই জানি যখন, থামলে চলব না। চলতি লেখাটা শেষ কইরা নেই। তারপর, তারপর সব হইব। সব হইব। মূল্যায়ন-টুল্যায়ন নিয়ে ভাবি না। টিকে থাকাতাই মূল্যায়ন। শিশুর মতো সহজ-সরল ভঙ্গিতে এতসব কথা বললেন তিনি।
আমি অপার বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনি। এক ফাঁকে ভাবী এসে চা-বিস্কুট দিয়ে যান। চায়ের কাপে চুমুক দেই। খড় খড় শব্দে দাঁত দিয়ে তোস্ট বিস্কুট ভাঙি। তিনি আরো বলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান, শওকত আলী বেশি বেশি পড়বেন। ভাবছি শিশুদের জন্য একটা পত্রিকা করব। শিশুরা বড়ো অসহায়। ওদের জন্যে কিছুই করা হচ্ছে না। কিন্তু পত্রিকা? না, তাও না। এই যে বাজারে দু’একটা দেখছেন এগুলো বাজারী পত্রিকা। শিশু-কিশোরদের শেখার মতো একটা পত্রিকা চাই। ওদের রুচি নষ্ট করে দিচ্ছে এ পত্রিকাগুলো। ফাজলামো হচ্ছে সব জায়গায়। অপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করেন। সব হবে। পত্রিকা হবে। লেখা হবে। নাটক হবে। সিনেমা হবে।
এরপর অনেক কথা হলো। অনেক। অনেক। অনেক।
জানা-অজানা।
ভালো লাগলো সেসব কথা।
ভাই, সময় করে একদিন আসবো। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানা হলো। মনটায় এতদিন কেমন জ্যাম লেগেছিল। আপনার সাথে কথা বলে হালকা বোধ করছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ আসবেন। ইচ্ছে হলেই চলে আসবেন। অনেকেই আসে। আড্ডা দেই। আড্ডা দেবেন। ভালো আড্ডা দেবেন। একটা কথা তো বলি নাই। ব্যক্তিগত কথা। এই যে বাড়িটা দেখছেন, এটা আমি করি নাই। বাপে কইরা দিয়া গেছে। আমরা ভাইবোনরা ভাগাভাগি কইরা থাকি। বাপে না কইরা গেলে থাকনের জায়গা আছিল না। লেখালেখি কইরা বাড়িগাড়ি হয় না। কেউ টেকা দিতে চায় না। যাউকগা, ভালো থাকবেন। মন চাইলে চইলা আসবেন।
অবশ্যই, অবশ্যই। তাহলে আজ যাই ভাই?
হ্যাঁ, হ্যাঁ আবার আসবেন। অবশ্যই আসবেন। আসবেন কিন্তু। আজ আমার একটু তাড়া আছে। ধ্রুবর ওখানে যাবো। কাজ আছে। ধ্রুবকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামে যাবেন। গ্রামে। মন ভালো লাগবে। গ্রামের কথা লিখবেন। ঠিক আছে, আসবেন আবার। আসবেন। আসবেন।
অনিচ্ছায় বিদায় নিতে হলো আমাকে। তিনিও বিদায় দিলেন।
তাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে এসে ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকি। যারা একরম ভালো লোকের সঙ্গ পান তারা কি একা চলতে পারে? পারে না। যারা ভালো তারা শিশুর মতো কথা বলেন। ঘোর কাটে, যখন পেছন থেকে নিতম্বে ধাক্কা দেয় রিকশার চাকা। আমি জ্যামে আটকে যাই। ডালপট্টির মোড় পেরুতে সতের মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। তার সাথে কথা বলে যে ভালোলাগাটা আমার ভেতর জুড়ে ছিল তা আস্তে আস্তে জ্যাম খেয়ে যাচ্ছে। এই জ্যাম-ট্যাম সব শেষ করে দিচ্ছে। সময়, সৃজনশীলতা, কাজকর্ম, সব, সবকিছু।
এরকম কেন হয়? বাইরের জ্যাম নাকি নিতম্বে চাকার ধাক্কা। তাহলে কোথায় যাবো? যেখানে জ্যাম নেই, নিতম্বে ধাক্কা নেই সেখানে যাবো? সে স্থান কোথায় পাবো? কোথায়?
জানি না। আমার জানা নেই তবে তার ঠিকানা, তার পরিবেশ আমার জানা… সেখানে তো যাওয়া যাবে। আমি আবারো জ্যাম ছুটাতে সেখানে যাবো। যাবোই।