২০২ বার পড়া হয়েছে
একজন সফিউদ্দিন আহমেদ
তিনি আমাদের ই সেনবাগের একজন কৃতি সন্তান ।নিবাস সেনবাগ বাজার থেকে কিছুটা পূর্বে অবস্থিত গ্রাম জামালপুরে। সফিউদ্দিন আহমেদ। “সফি সাহেব ‘” নামেই তিনি সমাধিক পরিচিত ছিলেন।
অত্যন্ত বর্ণাঢ্য , কর্মমুখর, বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারি সফিউদ্দিন আহমেদ কর্মজীবনে একজন কাস্টমস কর্মকর্তা ছিলেন।১৯২২ সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল মজিদ পন্ডিত,মাতা মাহমুদা বেগমের চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে স্ফুরণ ঘটে ক্ষুরধার মেধাশক্তির সঙ্গে সংগে মানবিক গুণাবলী ও নেতৃত্ব প্রদানের সহজাত বৈশিষ্ট্যের । পিতা আবদুল মজিদ পন্ডিত সাহেবের অসাধা্রণ বৈদগ্ধের সবটুকুই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে মেধায় -মননে প্রাপ্ত হন।
অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন সময়েই ভ্রমনপিপাসু ও দেশবিদেশ সম্পর্কিত বিচিত্র জীবন বৈচিত্র্য দেখা ও অনুধাবন করার জন্য তৎকালীন বংগের জ্ঞানবিজ্ঞানের ঐতিহ্যবাহী পীঠস্থান ও নগর রাজধানী কলকাতায় চলে যান। সেখানে দুই বৎসর অবস্থান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, জাপানী বোমাবর্ষণ , ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ,সমসাময়িক কলকাতা কেন্দ্রিক বিখ্যত ঘটনাবলী , ঐতিহাসিক স্থানসমূহ দেখা- জানা শেষে পুনরায় নোয়াখালি ফিরে আসেন। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রামেন্দ্র মডেল হাই স্কুলে (কল্যান্দী হাই স্কুল) ভর্তি হন। নিজেদের বাড়ি থেকে যাতায়ত দুর্গম ছিলো বিধায় লজিং (জায়গির) থাকতেন সেনবাগ বাজারের পশ্চিমে অবস্থিত গ্রাম লালপুরের “বড়বাড়ি”তে আলম উল্ল্যা মাষ্টার সাহেবের বাড়িতে। ইনি কলিকাতা কর্পোরেশনে চাকুরিরত ছিলেন বিধায় তাঁর পরিবারের দেখাশোনা’র দায়িত্ব ও একসময় সফিউদ্দিন আহমেদের উপর ন্যস্ত হয়ে যায়। এঁর সমসাময়িক হরিহর আত্মা বন্ধুদের একজন ছিলেন এম পি জ্বনাব মরহুম আবদুস সোবহান সাহেব (সেনবাগ রাস্তার মাথা)। আরেকজন বন্ধু ছিলেন মাষ্টার মেরিনার ক্যাপ্টেন শফিকুল ইসলামের পিতা ও ব্যারিষ্টার সৈয়দ তাজরুল ইসলাম, বর্তমানে নোয়াখালি সরকারি হাসপাতালের কৃতি সার্জন ডাঃ সৈয়দ কামরুল হাসানের এর নানা জনাব দীন মোহাম্মদ। সেনবাগ হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার পর মাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রথম ব্যাচের পরীক্ষার্থী ছিলেন সফিউদ্দিন আহমেদ। ১৯৪০ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (তৎকালীন) পরীক্ষায় পাশ করেন। চৌমুহনী কলেজ থেকে তিনি পড়াশনা শেষ করেন। সেখানে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি কলেজের স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম জি এস। তাঁর সে সময়ের একজন অন্যতম সহপাঠী বন্ধু ছিলেন মরহুম ডাঃ সামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী । ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন এবং ইংরেজি- বাংলা ,দুই ভাষাতেই অনর্গল হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় বক্তৃতা দিতে দক্ষ ছিলেন সফিউদ্দিন সাহেব। আরেকজন ইংরেজি ভাষার শিক্ষক মরহুম জনাব এমরাত আলি সাহেবের কাছ থেকে জানা যায়, চৌমুহনী কলেজে অধ্যয়ন কালীন সময়েই ইংরেজি শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে অধ্যক্ষ মরহুম তোফাজ্জল হোসাইন মহোদয়ের নির্দেশে সফিউদ্দিন আহমেদ (বি এ ক্লাশের ছাত্র) ইংরেজীর ক্লাস নিতেন। জনাব এমরাত আলী সাহেব আর ও বলেছেন- ওনার নেয়া ক্লাস কোন ও অংশেই কম আকর্ষণীয় কিংবা কম শিক্ষণীয় হতো না।
এই সময়েই তিনি যুক্ত হয়ে যান অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতির বাম ধারার সংগে। তখন তার মতো মেধাবী তারুণ্যের বড়ো অংশই ঝুঁকেছিল কম্যুনিজমের দিকে।শোষণমুক্তির ,গণমুক্তির প্রতি সংগত কারনেই দুনিয়া জুড়েই সাম্যবাদের জয় জয়কার । তবে সফিউদ্দিন আহমেদ এর কোনো বাম দল কিংবা কম্যুনিস্ট পার্টি র সংগে সরাসরি যুক্ত হননি। বরং সাম্যবাদের আদর্শে উজ্জীবিত দীক্ষিত তিনি সারাজীবনই যুক্ত থেকেছেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সংগে। ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সাপ্লাই এন্ড ডেভলপমেন্ট এ চাকরি তে জয়েন করেন।খুব সম্ভবত১৯৫৪ থেকেই যুক্ত হয়ে যান চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী ইউনিয়নের সংগে। তিনি পাকিস্তান “ইউকাসেফ”এর প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এ জন্য আইউব আমলে অনেকদিন তিনি ও মরহুম খোদাদাদ হোসেন গং অনেকদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে( আত্মগোপনে) ছিলেন।সে সব সময় গুলোতে তাঁর পরিবার পরিজন আর্থিক ও সামাজিক- সবধরনের নিরাপত্তা বিহীন অবস্থায় চরম ঝুঁকির মধ্যে ছিলো। সফিউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান সেন্ট্রাল স্পোর্টস এসোসিয়েশনের প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান ) শাখার একটিভ মেম্বার ছিলেন। ১৯৬০ সালের দিকে তিনি সিজিএস কলোনি (মসজিদ কলোনি) চট্বগ্রাম এ সরকারি বাসা এফ-৩/২২ এ এলোটি হিসেবে প্রাপ্ত হন। এবং সেই বাসায় ১৯৮৮ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় (সরকারি চাকুরিতে অবসরগ্রহন পর্যন্ত)বসবাস করেন। এই সময় কালীন তাঁর বিচিত্র সংগ্রামমুখর জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে ওই সরকারি বাসাটি অনেক ঐতিহাসিক গোপন প্রকাশ্য মন্ত্রনা সভার ও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির পদধুলির নীরব স্বাক্ষর বুকে ধারন করে আছে।
যদিও ১৯৬২ সাল থেকেই সফিউদ্দিন আহমেদ আগ্রাবাদ কলোনি এসোসিয়েশন এর সংগে যুক্ত ছিলেন তথাপি কলোনিতে এলটিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯০ সন পর্যন্ত তিনি আগ্রাবাদ কলোনি এসোসিয়েশন নামীয় প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।একটি অরাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান এর ব্যানারে এই প্রতিষ্ঠান টির রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস।একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম যে সশস্ত্র স্ফূরন আরম্ভ তা হয়েছিল চট্টগ্রামে।আগ্রাবাদ কলোনির জনসমাজ তথা তারুণ্য সেখানে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল।এর নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল কলোনি এসোসিয়েশন ও তার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব ব্যক্তিত্ব সফিউদ্দিন আহমেদ। সামরিক শাসক প্রভুদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগৃহের” স্বাধীনতা “নামক সন্তানের জন্মের প্রক্রিয়ার কর্ম কান্ড অকূতোভয়ে চালিয়ে গেছেন। ২৬ শে মার্চ সকালে মেজর জিয়াউর রহমানের ইংরেজিতে দেয়া ভাষনের বাঙলা অনুবাদ করে স্বহস্তে লিখে দেন এবং সেটি কলোনি মসজিদে পাঠ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের আহ্বান জানান সেখানকার অধিবাসী জনগন ও তারুণ্যকে। মেজর জিয়াউর রহমান স্বয়ং তাঁর সংগে কথা বলেন যে- প্রতিরোধ যুদ্ধে যেসব আহত মানুষেরা,তাদের চিকিতসা ও শুশ্রষার ব্যাবস্থা আগ্রাবাদে কোথাও করা সম্ভব কিনা। সফিউদ্দিন আহমেদ সেই দায়িত্ব এককথায় কাঁধে তুলে নিলেন।মার্চ মাসের উত্তাল অসহযোগ আন্দোলন ও চট্বগ্রাম শহরের প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধের দিনগুলিতে জুড়ে সিজিএস কলোনি হাসপাতালের দোতলায় প্রকাশ্যে- গোপনে (রাতে বাতি নিভিয়ে মোমের আলোয়) অনেক প্রতিরোধ যোদ্ধা (মুক্তিযোদ্ধা )র চিকিৎসা হয়েছিল। কয়েকজন মৃত্যুবরন করেছিলেন।এ সময়ে কলোনিতে বসবাসরত অবাংগালী (বিহারি) দের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে তিনি তৎকালীন হাজিপাড়ায় তাঁর সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত সহচর বন্ধু আশরাফ মিস্ত্রির সহায়তায় আত্মগোপনে থেকে এইসকল কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বদানের কাজটি চালিয়ে যান।মিলিটারী ও তাদের অবাংগালী দোসররা হন্যে হয়ে তাঁকে পাগল কুকুরের মতো খুঁজতে থাকে। তালা দেওয়া বাসাটি প্রতিদিন তারা এসে খুলে পরখ করতো,সেখানে কোন ও জিনিষে কেউ হাত দিয়েছে কিনা।অর্থাৎ সেখানে বাসার মালিক সফিউদ্দিন আহমেদ ঢুকেছেন কিনা।আগ্রাবাদে অবস্থিত হাবিব ব্যাংক( তৎকালীন) ও আর ও দুই একটি প্রতিষ্ঠান যেগুলোতে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সিকিউরিটির জন্য বন্দুক ও গোলাবারুদ মজুদ থাকতো,অসীম দুঃসাহসিকতায় নিজ দায়িত্বে তিনি সেগুলো তালা ভেংগে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে দেন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে। বলতে গেলে একবস্ত্রে,স্না্নাহারবিহীন ,বিনিদ্র অবস্থায় অসম প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম কাতারে থেকে লড়াই শেষে এপ্রিলে তিনি গ্রামের বাড়ি জামালপুরে চলে যান। এবং যাওয়ার পথেও আত্মগোপনের মধ্যেই ঘুরপথেই তাঁকে আসতে হয়েছিলো নোয়াখালির সেনবাগ। মিলিটারি রা তাঁকে খুজছিলো হন্যে হয়ে। তাঁর ছবিও দেয়া হয়েছিলো সেইপথের অনেকগুলো পয়েন্টে। পহেলা এপ্রিল সেনবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রারম্ভে মোহাম্মদপুরে সেনবাগ বাজারে আসার রাস্তাটি কেটে দেয়া হয় মিলিটারি র গতিরোধের জন্য। ওইসময় সফিউদ্দিন আহমেদ ও আসছিলেন নিজগ্রামের বাড়ির দিকে। তিনি তখন রিকশা থেকে নেমে মুক্তিপাগল তারুণ্যের সংগে সংহতি প্রকাশ করেন। এবং তাদের কে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার সাইক্লোস্টাইল কপি র কাগজটি দেন।সে সময় প্রত্যক্ষদর্শী ও সেই প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারী একজন হলেন বর্তমানে সেনবাগের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা জ্বনাব আবু তাহের।এপ্রিল থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নিজগ্রামের বাড়ি জামালপুরে স্ত্রী আট সন্তান , দুই ভাই,তাদের স্ত্রী সন্তান,বৃদ্ধ পিতা ,এদেরসবাইকে নিয়ে চরম অনিশ্চিত ও অভাব জর্জরিত জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে। এর মধ্যেই গোপনে মুক্তিযুদ্ধের মূলস্রোতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় খাদ্য অন্য সহায়তা দান করে গেছেন প্রাণপণে।যদিও তখন তাঁর পরিবার নিয়ে তাকে ও অর্ধাহারে দিনযাপন করতে হচ্ছিল। অপর দিকে তার গ্রামের হিন্দু পাড়ার অধিবাসীদের জানমাল রক্ষার জন্য ও তিনি অক্লান্ত প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছিলেন।স্থানীয় সুবিধাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কিছু মানুষ প্রকাশ্যে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সৎ ইমেজের জন্য কোন ও কিছু করতে না পেরে সিঁদ কেটে গৃহের সমস্ত স্থাবর যৎসামান্য সম্পদ ও নিয়ে যায়। কেউ কেউ রাজাকার বাহিনীর সাথে ও শলাপরামর্শ করতে থাকে তাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবার জন্য ।কিন্তু সেখানে তাঁর কিছু অনুরাগী শুভানুধ্যায়ীর কারনে তিনি রক্ষাপান। এসময় সেনবাগের হেদায়েতুল্লাহ চৌধুরী ও তার পিতা জনাব হাবিবুল্লাহ চৌধুরী ও সফিউদ্দিন আহমদের অনেকখানি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ওদিকে অবাংগালি প্রতিবশিরা মিলিটারির প্রত্যক্ষ মদদে তাঁর সরকারি বাসার সমস্ত মালামাল লুঠ করে নিয়ে তাঁকে একপ্রকার নিঃস্ব করে দেয়।কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চেতনা, শোষণহীন সমাজব্যবস্থায় চালিত বাঙ্গলাদেশ গড়ার কার্যকরী আদর্শকে মনে – মেধায় ব্যক্তিগত জীবনাচরনেও ধারন করেছিলেন।মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাণিজ্যে কখন ও অংশ নেননি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত একাধিক বইয়ে সফিউদ্দিন আহমেদ এর নাম উল্লেখিত হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী বিদেশি সাহায্য বিতরণের বিশাল গুরুদায়িত্ব এর মধেই সাবান,শিশুখাদ্য,চিনি ইত্যাদি জিনিষগুলো বিতরণের জন্য এক একটি স্লিপ তাঁর কাছ থেকে সই করিয়ে নিয়ে ভোক্তারা প্রাপ্ত হতেন (এটি ১৯৭৪ এর কথা) । কিন্তু তখনও তাঁর বাড়িতে নতুন জামাইকে ও গ্রামের বাজার থেকে কেনা সস্তা গুড়ের তৈরি চা ই খাওয়ানো হতো,কাপড় কাচা হতো সোডা দিয়ে,তার পরিবারের সদস্যদের কিনে দিতেন ,নিজে পরতেন ,পুরোনো কাপড়ের দোকান থেকে সস্তায় কেনা পরিধেয় বস্ত্র। চট্বগ্রামের আগ্রাবাদে জন্ম নেয়া , বেড়ে ওঠা ষাটের দশকের ছেলেমেয়েদের কাছে সফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সুপরিচিত অনমনীয় কঠোর ব্যক্তিত্বের অবসংবাদিত নেতা “ সফিচাচা”। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা এইসকল কৃতি সন্তানদের অনেকেই এখন বার্ধক্য’র দ্বারপ্রান্তে উপনীত। তথাপি তাঁদের হৃদয়ে অম্লান তাঁদের জীবন স্মৃতি তে সফিউদ্দিন আহমেদ কড়ি ও কোমলে মিশ্রিত এক আপদে বিপদে সর্বদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, ঝাঁপিয়ে পড়া এক কাছের মানুষ- এক নেতার নাম। তিনি সি জিএস কলোনির ষাটের দশকের অতি সাধারণ একটি টিনের ছাপড়া মসজিদকে ১৯৮৮তে চট্বগ্রাম ছেড়ে আসা পর্যন্ত উন্নীত করে দিয়েছিলেন দ্বিতল সুবিশাল পরিসর , সমৃদ্ধ ও সামনে অনেকখানি খোলা মাঠ বিশিষ্ট সুরম্য মসজিদে।এজন্য সিজিএস কলোনি ক্রমশ মসজিদ কলোনি নামেও পরিচিতি পায়। এই মসজিদের পিছনে আছে জমজমাট বেশ কিছু বড় বিভিন্ন ধরণের দোকান সংবলিত মার্কেট মোটা অংকের অর্থ পায় মসজিদ কমিটি এ থেকে মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েই ১৯৬৬ সালে (অনুমিত) এই মসজিদের সীমানা প্রাচীরটি (বাউন্ডারী ওয়াল) কোনো একটি স্বার্থঅন্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য একরাত্রির মধ্যে নির্মাণ করে ফেলা হয়। কিন্তু বিরুপ স্বার্থান্বেষী মহলের রোষানলে পড়ে তাঁর চাকরি চলে যায়।সাত সদস্য বিশিষ্ট পরিবার ছাড়াও ভাই-বোন পিতামাতা সহযোগে একটি বিশাল পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে থাকার পরও তিনি ছিলেন অকূতোভয়।পরে সেই বছরেই তিনি তৎকালীন পাকিস্তান এর সেন্ট্রাল এক্সাইজ ( ল্যান্ড কাস্টমস) এ চাকরি পান। সেখানে থেকেই ১৯৮৮ র দিকে অবসরে যান।তাঁর আজীবনে অক্লান্ত কর্ম সাধনায় তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি হাই স্কুল (বালক শাখা, বালিকাশাখা), সি জিএস কলোনি লেডিজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল হোম ,কলোনি হাসপাতাল , কলোনি ক্লাব,ক্লাব সংলগ্ন সুবৃহৎ কম্যুনিটি সেন্টার। সি জি এর কলোনিতে (পুরাতন) প্রতি চার বিল্ডিং এর পিছনে মাঠে পানি সরবরাহ সুনিশ্চিত করার সুবিধার্থে বেশ ক’টি ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণ,বিশাল সি জি এস কলোনির চারপাশে নিরাপত্তা এবং কলোনির দৃষ্টিনন্দন আভিজাত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ এই কাজগুলো করা হয়েছিলো আগ্রাবাদ কলোনি এসোসিয়েশনের ব্যনারে। আর সেই ব্যানারটি অবিচল নিষ্ঠার সাথে ধরে রেখেছিলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সফিউদ্দিন আহমেদ। বেশ কয়েকজন নিবেদিতপ্রান বন্ধু,শুভানুধ্যায়ীকে তিনি এই সময়ের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন পাশে।অনেকেই তাঁর ভক্ত ,গুণমুগ্ধ ছিলেন। এবং তাঁরা অনেকেই প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারী হয়েও (চাকুরিস্থলে রফিউদ্দিন আহমেদ এর বস)তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন।তবে তাঁর সহযোদ্ধারা সংসার, চাকুরী পরিবারের প্রতিপালনের জন্য ঘরে ফিরে যেতেন,তিনি বলতে গেলে ঘরে ফিরতেনইনা। সেই সময়ের কলোনি এবং আগ্রাবাদ এলাকার প্রতিটি মানুষ নির্বশেষে শিশু,বৃদ্ধ, যুবা জানতো দিন রাত্রির প্রতিটি প্রহরে,মুহূর্তে, দুর্যোগেও একজন মানুষকেই বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য, অকুতোভয় সহায় হিসেবে পাশে পাওয়া যাবে- তিনি সফিচাচা,সফিভাই,সেক্রটারি সাহেব..।কতো পরিবর্তন আজ আগ্রাবাদের কাহিনী বয়ানে! অবশ্য এসবে সফিউদদীন আহমেদ (এমনকি তাঁর পরিবরেরও)এর কিছু যায় আসেনা।তিনিতো কিছু পাবার প্রত্যাশায়, কোন সম্মাননা, পুরষ্কার অথবা গুন- মহিমা কীর্তন প্রত্যাশায় এসব কাজ করেননি। ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সি জিএস কলোনি সারভেন্টস কোয়ার্টার ( প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মচারিদের গৃহকর্মী দের বসবাসের জন্য নির্মিত ) দুটি তে বসবাসরত প্রায় ছিন্নমূল মানুষগুলি , বর্তমানে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই মহৎ হৃদয় মানুষটির সুবিচার ও তাদের প্রতি সহমর্মী ভালোবাসা ধারণকারী মানুষটির কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধার সংগে। বর্তমানে অপরিচ্ছন্ন,অব্যবস্থায় ভারাক্রান্ত,অভিভাবকহীন,পরিচর্যাহীন, হতশ্রী সিজিএস কলোনিতে যদিও কলোনি এসোসিয়েশনটি এখনো বর্তমান ,কিন্তু সফিউদ্দিন আহমেদ এর মতো নিবেদিতপ্রাণ, নিঃস্বার্থ, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব টি সেই সময়ের তারুণ্য ও বর্তমানে প্রায় বৃদ্ধ প্রত্যক্ষদর্শীরা মর্মে মর্মে অনুভব করেন,বলেন। তাদের,তাঁদের অন্তরীন শ্রদ্ধার স্বর্ণজলে খোদাই করা আছে তাঁর নাম। সেটাই সফিউদ্দিন আহমেদের পুরষ্কার। এ শুধু অনুভবের। দৃশ্যমান ও হতে পারতো, কিন্তু বিস্মরণ ও সচেতন উপেক্ষার এ পোড়া দেশে তা পুরণ হবার নয়, অসম্ভব! ১৯৮৮ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত নিজগ্রাম জামালপুর ও সেনবাগ বাজারেও তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন অনেক অনেক সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা ও পরোপকারী অভিজাত ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর।
ব্রেণ ষ্ট্রোকে কোমায় চলে গিয়ে প্রায় নয়মাস শুধু নিশ্চল প্রাণধারণ করে চব্বিশে আগষ্ট , ২০০৯ ইংরেজি ৯৮ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ ,
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান–!”