ইমাম হোসাইনের (রা:)” কারবালার প্রান্তরে সেদিন কি ঘটেছিল?
সেই সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গেলে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। ওই ঘটনা বলার আগে আমি আশুরার তত্ত্বকথা বলতে চাই
হিজরী সনের সর্বপ্রথম মাস মুহাররম এ মাসের গুরুত্ব অন্যান্য মাস থেকে আলাদা অর্থাৎ 10 ই মহররম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় একটি দিন পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে উম্মতের উপর এদিনের রোজা ছিল ফরজ। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এই রোজা না ফলে পরিণত হয় বুখারী শরীফ খন্ড 1 পৃষ্ঠা 268
হাদিস শরিফে বর্ণনামতে এ দিবসে রোজা রাখা সফল হওয়া সত্বেও এর গুরুত্ব কমে যায়নি বিন্দুমাত্র। যদি কোন ব্যক্তি এ দিন রোজা রাখে তবে আল্লাহতায়ালা তাঁর পূর্ব ও পরবর্তী পূর্ণ এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেন (মিশকাত শরীফ 179)
আশুরার পবিত্র দিবসটি হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার কারণেই শুধু তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বের আসন পায় নি। বরং মানব ইতিহাসে বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা জড়িয়ে আছে এ দিনটির সাথে। এদিনেই আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম আলাই সাল্লাম এর তওবা কবুল করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম আলাই সাল্লাম এর উপর নমরুদ কর্তিক প্রজলিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কে ঠান্ডা ও আরামদায়ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সাল্লাম কে স্বজাতি বনি ইসরাইল সহ ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নাজাত দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে আসার পর, মদিনার ইহুদিদের এ দিনে রোজা রাখতে দেখে প্রশ্ন করলেন তোমরা এ দিবসে কিসের রোজা রাখ? তদুত্তরে ইহুদীরা জানানো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মূসা আলাইহিস সাল্লাম এবং তাঁর উম্মত বনী ইসরাঈল এ দিবসে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন আর এ দিনেই ফেরাউন সদলবলে লোহিত সাগরে ডুবে মরেছিল। নিমজ্জিত হয়ে ই দামে বাদশাহী করার খায়েশ পড়েছিল চিরজনমের জন্য। আমরা এর সকল আদায়ের লক্ষ্যে এ দিনটিতে রোজা রেখে থাকি। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হযরত মূসা আলাইহিস সালামের অনুসরণের দাবিদার তোমাদের চেয়ে আমি বহুগুণে বেশি অতঃপর রাসুল সালাম নিজের রোজা রাখেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (বোখারী শরীফ প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা 268) উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা একথা সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয় যে, শুধুমাত্র কারবালার ঘটনার কারণেই এ দিবসটি তাৎপর্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি। বরং আল্লাহ পাক হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদাত এর জন্য এমন একটি মোবারক দিবস নির্বাচিত করেছেন যে কারণে তার শাহাদাতের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ দিনে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় সকলের নিকট এ দিবসটি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর শাহাদাত এর ঘটনা। শাহাদাতের অদম্য স্পৃহা ও রেজায়ে মাওলার বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সাথী সঙ্গীরা বড়লোকের ডাকে সাড়া দিয়ে একে একে নিজেকে মৃত্যুর কোলে সঁপে দিলেন। জীবন বাজি রেখে বীরদর্পে যুদ্ধ করতে করতে সবাই তখন তাকে একা ফেলে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন। তখনো শত্রুবাহিনীর কারো সাহসে কুলালো না অস্ত্র হাতে তার দিকে এগুবার। একদিকে সাথী সঙ্গীহারা মামূলী অস্ত্রহাতে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, পিপাসায় কাতর একা এক বিদেশি মুসাফির। অন্যদিকে বিভিন্ন অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত স্থানীয় বেনিয়াদের এক বিরাট বাহিনী। একদিকে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী এর চেতনায় উদ্বেলিত 1 আহত চিতা অন্যদিকে ক্ষমতালিপ্সু খুন পিয়াসীদের পদলেহী একদল ধূর্ত শৃগাল।
একে তো হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর স্ত্রীর সামনে হাজির হওয়ার সাহস কারো হচ্ছিলোনা। দ্বিতীয়তঃ এত বড় পাপের বোঝা কেউ নিজের মাথায় নিতে রাজি ছিল না। এই জটিল পরিস্থিতিতে কেন্দা গোত্রের মালিক ইবনে নুসাইর নামক এক পাষণ্ড হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো। তিনি এ আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়লেন। আঘাতের যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন। এ সময়ে তার কোলে ছিল নিজের শিশু বাচ্চা আব্দুল্লাহ। তাকে তিনি আদরে সোহাগে মাতিয়ে রেখেছিলেন। বনি আস- আদের এক নির্দয় পাষণ্ড বাচ্চাটি কে উদ্দেশ্য করে তীর ছুড়লে তীরের আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটিও মৃত্যু কোলে ঢলে পরলো। হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এই নিষ্পাপ শিশুটাকে মাটির উপরে শুইয়ে দিয়ে খোদার দরবারে প্রার্থনা করলেন প্রভু হে তুমি নিজেই এই অত্যাচারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করিও। পানির প্রচন্ড তৃষ্ণা আর সহ্য করতে না পেরে তিনি ফোরাতের দিকে অগ্রসর হলেন। এই সুযোগে হাসিন ইবনে নুমাইর হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়লে তাকিয়ে তার কণ্ঠদেশে বিদ্ধ হয়। ফলে রক্তের ধারা বয়ে যায় কন্ঠনালী থেকে। এ সময় সিমার অস্ত্রে সুসজ্জিত 10 জনের এক চৌকস বাহিনী নিয়ে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তৃষ্ণার্ত হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে । এই করুন অবস্থায় কোন অলৌকিক শক্তি যেন তার ওপর ভর করল তিনি একা এই দশ জনের বিরুদ্ধে বীরদর্পে অব্যাহত গতিতে লড়ে যেতে লাগলেন। তার বিরামহীন তীব্র আক্রমণ এর সামনে কেউ আর স্থির থাকতে পারছিল না তিনি যে দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন শত্রুরা সে দিক থেকেই পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে এটি একটি অসাধারণ ঘটনা। যার চোখের সামনে পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন খোদার রাহে একে একে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। নিজেও যিনি শত্রুদের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত। এমন একজন লোক কি করে এমন নির্ভীকভাবে দৃঢ়তা ও বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে পারলেন এ তো কল্পনা করতেই কষ্ট হয়। এমন এক ব্যক্তির আক্রমণের তীব্র তার সামনে সুসজ্জিত এক বিরাট বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে প্রাণ রক্ষা করাই যেন তাদের জন্য দূরহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সীমারের এই অবস্থা আর সহ্য হলো না সে চিৎকার করে সকলকে একযোগে আক্রমণ করার আহ্বান জানালো তার এই ডাকে সাড়া দিয়ে কয়েকজন দুর্ভাগা একযোগে তার উপর আক্রমন চালালো তাদের ঐক্যবদ্ধ হামলার তীব্রতা সইতে না পেরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কলিজার টুকরা হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শাহাদাতের শরাব পান করলেন। সেইসাথে হিজরত করে চলে গেলেন এ নশ্বর পৃথিবী থেকে অন্তলোকের চির শান্তির নীড়ে ।
(ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)
কারবালার শিক্ষা: কারবালার হৃদয় স্পর্শী ঘটনা মূলত একই সাথে বেদনা ও জাগরণের এক যৌথ অধ্যায়ে। বেদনা নিষ্ফল বলেই প্রয়োজন জাগরনের। অশ্রুর ভাষায় পঠিত ইতিহাসকে চেতনা সমুজ্জ্বল দরসে পরিণত করা উচিত। বাতিলের সাথে আপোষ না করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার এই ঝুঁকিবহুল বিষাদময় ইতিহাস মূলত বিপ্লবের এক প্রতিবাদী চেতনা জন্মেরই দাবি রাখে। কারবালার ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে সঠিক ও সময়োচিত পদক্ষেপ। এ হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ যদি একথা বলার অপপ্রয়াস চালায় যে অন্তত আংশিক হলেও হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর একরোখা মনোভাবকে দায়ী করা যেতে পারে।তবে এটা ভুল হবে। আর সুস্থ মস্তিষ্ক থেকেই এমন ভাবনার উদ্ভব ঘটানো সম্ভব। কারণ হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর বিভিন্ন ভাষণে এবং সুস্থ মানসিকতা নিয়ে ইতিহাসের সঠিক ও নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণে একথাই প্রমাণ হয় যে এক্ষেত্রে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সিদ্ধান্তই ছিল সম্পূর্ণ সঠিক ও নির্ভুল। ইমাম হোসাইন রদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করব অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করব না আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই শিক্ষা বাস্তবায়িত করে জীবনটাকে ও সমাজটাকে ন্যায় এর পথে সাজাতে যেন সুযোগ করে দেন এই বলে আজ আমি এখানেই শেষ করছি পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখা হবে। সকলের জন্য শুভকামনা।
লেখক: মুহাম্মদ লোকমান সাইফি (ইসলামী আলোচক: বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড)