আবার ফিরবো
[ শিরীনা ইয়াসমিন ]
লাশকাটা ঘরে পরে আছি;
আমি কি মারা গেছি?
দুটো লোক হাসাহাসি করছে,
বলছে এমন অদ্ভুত কারণে কেউ মারা যায়?
মেয়েটি নাকি প্রকৃতির প্রেমে পড়ে মারা গেছে।
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো ওরা,
হাসির শব্দে ঘরটা কেঁপে উঠলো।
একজন বলে ওঠলো, মালটা বড় খাসা ছিলো রে!
আমি শিউরি উঠলাম,গা গুলিয়ে উঠলো।
অন্যজন ধমক দিয়ে বললো,
চেয়ে দেখ, মেয়েটির মুখটা কেমন মায়াবী!
তখন আমার মনে পড়লো মায়া—
কতকিছুর প্রতি আমার মায়া ছিলো;
এক টুকরো চাঁদ, এক খণ্ড নীলাকাশ, মাছরাঙা,
হিজল ফুল, ডিঙি নৌকা, কৃষ্ণ বর্ণ একটা মুখ;
এসবের জন্য কেউ মারা যায়?
ওরা দুজনে আবার বলাবলি করছে,
মেয়েটি বেওয়ারিশ, কেউ ওর খোঁজ নিতে এলো না।
বলতে না বলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো মাছরাঙা,
হিজল, নীল শাপলা, ডিঙি নৌকা,
নীলাকাশ, আর এক খন্ড চাঁদ।
ওকে ছোঁবে না, দিয়ে দাও আমাদের,
আমরা ওকে নিতে এসেছি।
একজন রক্তচক্ষু করে বলে উঠলো,
কোথায় নিয়ে যাবে?
যতোসব আজগুবি কথা।;
অন্যজন বললো এতো বছর লাশকাটা ঘরে আছি ;
এমন ঘটনা তো কখনো দেখিনি!
হঠাৎ মাছরাঙা বলে উঠলো,
ওকে আমার কাছে নিয়ে যাবো,
আমার সাথে মাছ ধরবে,উড়ে বেড়াবে।
ওরা নিজেদের মধ্যে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লো।
এ বলে আমি রাখবো,ও বলে আমি রাখবো।
তুমুল হট্টগোল বেঁধে গেলো;
হঠাৎ আমার মনে পড়লো ও কোথায়?
ও এলোনা কেনো?
তখন একটা গানের লাইন মনে পড়ে,
হাসি চলে এলো।
ওরা বলে উঠলো কে হাসে এমন উচ্চস্বরে ?
এমন কান্ড যেন কখনোই দেখেনি ওরা! হাসিতো বন্ধ হয় না—
একটা গান লিখেছিলাম ” আমি মইরা আবার জিন্দা হইতে চাই,
আমি ভালোবাইসা একবার তোরে,
আমার করতে চাই”।
কত ভালোবেসেই না লিখেছিলাম গানটা।
আমি কি ওর জন্যে মারা গেছি?
না না, আমি তো নীল হিজল ফুলটার জন্য মারা গেছি।
আমি বেঁচে থাকতেই ওর কেনো মরতে হলো?
কতবার আমি কতকিছু হতে চেয়েছি;
মাছ হতে চেয়েছি,গাছ হতে চেয়েছি,
বিল হতে চেয়েছি,পারুলি নদীর ঢেউ হতে চেয়েছি।
মাছ ধরার প্রেমেও পড়েছিলাম;
মাছ না পেয়ে, চিলাই নদীর পাড় ধরে কতদূর চলে গিয়েছিলাম।
খুব ছোট ছিলাম, ভয়ে গুটিয় গিয়েছিলাম।কিন্তু পথই আবার পৌঁছে দিলো বাড়ি।
বনে বাদারে ঘুরে ভ্রোমর ধরে আনতাম,
কৌটোর মধ্যে রেখে কড়ইয়ের পাতা খেতে দিতাম।
ওরা ডিম পাড়তো,বাচ্চা ফোটাতে পারেনি।
ওটা অবশ্য ভ্রোমর ছিলো না,
ওটা ছিলো লেডি বাগ।
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, আমি মারা গেছি!লাশকাটা ঘরে মেঝেতে পড়ে আছি।
ওরা কি করবে আমাকে?
কেটে আমার শরীরের সব অঙ্গ আলাদা আলাদা করবে?
তখন আমার মনে পড়লো,
আমি তো মরোনোত্তর চক্ষু দান করেছিলাম!
আমার চোখের কি হবে?
ওরা কি চোখ দুটোকে বাঁচাতে পারবে?
কি করে পারবে?
ওরা তো জানে না আমি চক্ষু দান করেছিলাম।
ভেবেছিলাম, আমি চলে গেলে, এই চোখ দুটো আবার প্রকৃতি দেখবে।
যে নিবে চোখ দুটো, সেকি আমার মতো করে ওদের ভালোবাসবে?
আহা! নীল ডানার প্রজাপতি;
তোরা ভালো থাকিস,
আহ!ঘাসফুল, হিজল, পারুলি নদীর টলটলে জল ভালো থাকিস!
ভালো থাকিস ভোরের শিশির, শিউলি,
ভালো থাকিস বকুল ফুল।
আমি আবার ফিরবো নীল হিজল হয়ে।
দেখিস ফিরবোই!