মধ্য জুলাইয়ের এক মধ্যাহ্নে !
চট্টগ্রাম সমিতির পিকনিক আর ‘ পোর্ট জাফারসন ’ এর হেরিটেজ হোটেল !
প্ল্যানটা ছিল নিউ ইয়র্কে ‘ চট্টগ্রাম সমিতি’ র পিকনিকে অ্যাটেন্ড করা। নিউ ইয়র্ক প্রবাসী চট্টগ্রামের কামাল হোসেন মিঠুর দাওয়াতে তাঁর সাথে আমিও ছুটেছিলাম পিকনিকে। লং আইল্যান্ডের সাফোক কাউন্টির ‘ প্রোটন পয়েন্ট পার্কে ‘ পিকনিক। যদিও মিঠু থাকেন কুইন্সে, বেবিলন থেকে একঘণ্টা ড্রাইভ। আর পিকনিক স্পট প্রোটন পয়েন্টে যেতে আধা ঘণ্টা। পথেই পড়বে বেবিলন। মিঠু বেবিলনে পৌছাতেই সঙ্গী হলাম আমি।
পিকনিক মানেই শীত মৌসুম, আর দলে দলে বাসের ছাঁদে মাইক লাগিয়ে ফুল ভলিউমে কান ফাটিয়ে হিন্দি গানের আওয়াজ তুলে , ‘ লাল দোপাট্টা মলমলকে ‘। এখানে নিউ ইয়র্কে একেবারে উল্টো। ভরা গ্রীষ্মে কড়া তাপে পিকনিক। মাইকের কোন সুযোগই নাই। তবে পিকনিক স্পটে নিচু শব্দে গান করা যাবে লাউড স্পীকারে। আর গ্রীষ্ম ছাড়া পিকনিকের কোন উপায়ও নেই নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্কের শীতে খবর আছে। তখন ঘর থেকে কাজে যেতেই…, পিকনিক তো দূরের কথা। সে কারনে তীব্র সামারেই পিকনিক কাঠ ফাটা রোঁদেই ! তবে কাঠ ফাটা রোঁদ হলে কি হবে বিশাল বিশাল গাছের ছায়া আছে না। সেই রকম ছায়া যাকে বলে।
চট্টগ্রাম সমিতি মানেই বড় ব্যাপার। আর পিকনিক মানেই তো গেট টুগেদারে আনন্দ। কোভিড দুর্যোগের পর দূর দূরান্তের দেখা সাক্ষাতের আনন্দের এই পিকনিক। সেই সাথে মাস্ক বিহীন মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে অক্সিজেন গ্রহণের দারুন সুযোগ ! যদিও বেশ আগেই মাস্ক উঠেছে নিউ ইয়র্ক।
আনন্দে মেতে উঠেছে ছোট বড় সবাই। সেই সাথে যোগ হয়েছে চট্টগ্রামের বিখ্যাত আঞ্চলিক গান। গানে সবাই বেশ পারদর্শী, পারদর্শী আঞ্চলিক গানেও। কিন্তু চমকে উঠেছি এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী শ্যাম সুন্দর আর শেফালি ঘোষের সেই বিখ্যাত গান ‘ বকশির হাটের পানের খিলি তোরে খাওয়াইতাম ‘ !
ওয়েলকাম ড্রিংসের মতো প্রাণ জুড়ানো গোলাপি রঙ আর স্বাদে মিষ্টি তরমুজ খেয়ে প্রাণটা জুড়ালো। যেন পতেঙ্গা ছুটে এসেছে নিউ ইয়র্কে।
মিঠু দেখি দারুন পছন্দের মানুষ। সবাই ছুটে এসে কুশল জানতে চাইছে আর সেই সুযোগে আমিও পরিচিতি লাভ করেছি অনেকের।
বহুদিন পর খোলা যায়গায় দেখি যত্রতত্র দাঁড়িয়ে আছে ‘ ব্যাঙের ছাতা ‘। আমাদের দেশের চেয়ে একটু বড়ই। আমাদের এক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ব্যাঙের ছাতার নীচেই স্থির এক ব্যাঙের ছবির কথা মনে পড়ে গেলো। আমি সেই ছবি দেখে বিস্মিত ! ব্যাঙ কি করে এলো ছাতার নীচে ? আমি যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত তখন হটাৎ মিঠু বললেন, ‘ চলেন আপনাকে ‘ মনটাক ’ দেখিয়ে আনি ’। সমুদ্র সৈকত ‘ মনটাক ‘ ? এমনিতেই নাচুনী বুড়ী তার উপরে আবার ঢোলের বাড়ি!
গাড়ি ছুটলো পার্কের বাইরে কিন্তু দেখা গেলো
GPRS বলছে ‘ মনটাক ’ দুই ঘণ্টার পথ। তার মানে যাতায়াত ৪ ঘণ্টা। আমাদের হাতে সময় কই , ফিরে এসে আমরা খাওয়ায় বসতে হবে।
লোকেশন চেঞ্জ করলো মিঠু। এবার অন্য স্পট , ‘ পোর্ট জেফারসন ’। ওটা বেশি দুরে না। আধা ঘণ্টা ড্রাইভ। তবে ‘ মনটাকে ‘ মন পড়ে থাকে। মনে মনে অন্য সময় যাওয়া কথা ভাবি।
‘ পোর্ট জেফারসন ’ এসে মনটা ভড়ে গেলো। এমন সাজানো গোছানো ছবির মত পর্যটন স্পট ‘ পোর্ট জাফারসন ’ ! আহ, কি দারুন , সাজানো গোছানো যায়গাটা। পুরো এলাকায় পর্যটকদের হাঁটাহাঁটি। না, গায়ে গা লাগার মত নয়। ছিমছাম। যদিও ‘ পোর্ট জাফারসন ’ সাথেই আবাসিক এলাকা। মাত্র ৭ হাজার মানুষের বাস। পাখীর চোখে নয় ড্রোনের চোখে দেখা যায় তেমনই সুন্দর। গ্রাউন্ড থেকে আই পয়েন্টেই যদি এমন সুন্দর সব দৃশ্যমান হয় তবে কত না সুন্দর আকাশ থেকে হবে ?
কামাল হোসেন মিঠুকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনা।
মিঠু চট্টগ্রামের ছেলে। আমিও কম কিসে। নানার রেলের চাকুরী আর সাংবাদিকতা জীবনে চট্টগ্রামে যত না অ্যাসাইন্মেন্ট কাভার করেছি সেই সুবাদে, অ্যাঁরাও আধা চাটগাইয়া পোয়া !
চট্টগ্রামকে মনে পড়লে মিঠুর সাথে আমারও বার বার মনো কষ্ট জাগে। চট্টগ্রামের অপূর্ব ফয়েজ লেক, রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই লেক , শুভ লং , খাগড়াছড়ি , সাজাক, নীলগিরি, কক্সবাজারের বীচের কথা মনে করে। ছোট্ট একটা বন্দর শহর পোর্ট জাফারসন, কোথাও একটা মরা পাতাও পড়ে না চোখে। ঝক ঝকে পরিষ্কার। যদিও সূর্য একবারেই মধ্য গগণে। কিন্তু কই খারাপ তো লাগছে না। এটাতো জানি এমন কট কটা আলোতে ছবিও ভালো হয়না। মন আর প্রকৃতি বলে কথা ! মন চায় মনোরম হাল্কা আলো। আর ছবিতে আলোর খেলা না উঠে এলে মানুষের কমল মন ছোঁয়া যায়না।
সাদা সাদা সব কাঠের হোটেল রেস্টুরেন্ট। কি সুন্দর গোলাপি ফুলদিয়ে সাজানো। যদিও এলাকার মানুষের চেয়ে বেশি বাইরের মানুষের টুরিষ্টদের ভিড়। মিঠু যেমনটা বলেছিলেন, পোর্ট জাফারসনে আসার পথে , নিউ ইয়র্কের হেরিটেজ তালিকায় এই হোটেলের কথা। নিজ চোখে দেখে মন ভড়ে না ক্যামেরায় তুলতে মন চায়। কি সুন্দর সাজানো আছে এখানে।
কাঠের তৈরি হোটেল গুলির ইন্টেরিয়ারও দারুন ভালোলাগার। জাহাজের ভিতরে যেমন সাজসজ্জা থাকে সেই আদলে। পোর্টটি ১৭শ শতাব্দীতে তৈরি। ১৯শতকের মাঝামাঝি সময় এখানে শিপইয়ার্ড গড়ে উঠে। আর মার্চেন্ট মেরিনদের আনাগোনায় তৈরি হয় তিনতালা কাঠের আবাসিক হোটেল। যা এখন সরকার ঘোষিত ‘ হেরিটেজের ‘ অংশ। অবশ্য ‘যেমন আছে তেমন ‘ রাখার শর্তে টুরিস্টদের ব্যবহারের জন্য পরিচালিত হচ্ছে হেরিটেজ হোটেল গুলি। লং আইল্যান্ডের ‘ সাফোক ‘ কাউন্টির এই পোর্ট থেকে ‘ ক্যানেকটিকা অঙ্গ রাজ্যে দিব্বি চলছে ‘ ফেরী ‘ যাতায়াত, নিশ্চয়ই সার্ভিসটাও দারুন !
পানির উপর দিয়ে কাঠের তৈরি সেতুতে হাঁট গিয়ে মিঠুর চোখে চট্টগ্রামের ‘ ফিরিঙ্গি ‘ বাজারের কথা মনে পড়লো। আমিও শায় দিলাম তাঁর কথায়। মনে পড়লো, মরহুম মেয়র মহিউদ্দিন ভাই ৯৬ সালে যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন সে সময় চট্টগ্রাম শহরের কথা। মনে আছে মিঠু ? জ্বলে উঠেছিল চট্টগ্রাম শহর। আমি তখন আমেরিকান বার্তা সংস্থা এপি তে। পরদিন ছুটে গিয়েছিলাম বিমানে। চট্টগ্রাম যাবার আগেই খবর এলো ‘ কারফিউ ‘ দেয়া হয়েছে চট্টগ্রামে। সকালে পতেঙ্গায় নেমে সাম্পানে ভেসে ভেসে নামলাম ফিরিঙ্গি বাজারে। পানিতে তো আর কারফিউ নেই। আমাকে মোটর বাইকে চড়িয়ে আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে তখন কার দুর্দান্ত সাংবাদিক ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ ওসমান গণি মন্সুর আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বিপদজনক উতপ্ত শহরে বিভিন্ন স্পটে।
পাভেল রহমান
নিউ ইয়র্ক।
২০ জুলাই ২০২১
ব্যাঙের ছাতা, পিকনিক। পোর্ট জাফারসন, মিঠু আর আমি। টপ শট দুইটি নেট থেকে নেয়া