১৫২ বার পড়া হয়েছে
আত্মজা।
শিরীনা ইয়াসমিন।
নবনীতা খুব সাধারণ জীবন যাপন করে। একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। ওর পিসি বিধবা,বাবা – মা মারা গেছেন। সেই থেকে নবনীতা ওর বিধবা পিসিকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন।একদিকে পিসির প্রতি দায়িত্ব অন্যদিকে ওর একলা জীবনের সঙ্গী।
নবনীতার বিয়ে হয়েছিল,ওরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ত।পছন্দ করেই ওরা বিয়ে করেছে।অসীম ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, পরে ইউনিভার্সিটির টিচার হয়।বিয়ের পর নবনীতা অসীমকে ওর চরিত্রের ঠিক উল্টোভাবে আবিষ্কার করে।নবনীতা যে অসীমকে চিনতো তার সাথে অসীমের কোন মিল নেই।
ছ’মাস না যেতেই নবনীতা হাপিয়ে ওঠে। ঠিক ছ’মাস নয় প্রথম রাতেই নবনীতা পুরোপুরি ভেঙে পরে অসীমের এক প্রশ্ন শুনে।তবুও চিন্তা করেছে বিয়ে যেহেতু হয়েছে ওকে শুধরে নেয়া যায় কীনা ভেবেছে।আসলে মানুষ কখনো বদলায় না;সে ভিতর থেকে যেরকম সে রকমই থাকে।
আস্তে আস্তে অসীমের মনবিকৃতি ওর সামনে আসতে থাকে।নবনীতা দিশেহারা হয়ে পড়ে।কাউকে শেয়ার করতে পারেনা।অবশেষে মনোচিকিৎসকের সাথে আলাপ করে। চিকিৎসক অসীমকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলে, অসীম রাজি হয় না।

নবনীতা সব মেনে নিলেও অসীমের সন্দেহ বাতিকতা আর যৌন বিকৃতি মেনে নিতে পারে না।ডাক্তার বলেছেন মানসিক সমস্যায় যারা ভোগে তাদের এমন বিকৃতি দেখা যায়।
নবনীতা ডিসিশন নেই আলাদা হওয়ার,এতে অসীম খুব হিংস্র হয়ে ওঠে। তারপর আদালতের মাধ্যমে ওরা আলাদা হয়ে যায়।অসীম নবনীতাকে চাকুরী করতে দেয়নি।নবনীতা ডিভোর্সের পর ঢাকা ছেড়ে নিজ এলাকায় অর্থাৎ ময়মনসিংহ চলে যায়।তারপর একটা বেসরকারি ব্যাংকে যোগাযোগ দান করে।
নবনীতা আর বিয়ের কথা ভাবেনি।এখনও একাই আছে।ওর আত্মীয় স্বজন বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু ও রাজী হয়নি।ব্যাংক আর বাসা এই ওর পৃথিবী। ফেইসবুক এ একাউন্ট থাকলেও খুব বেশি এ্যাক্টিভ নয়।
করোনা আসার পর কিছুদিন বাসায় বসে কাজ করতে হয়েছে তখন এফ বিতে এ্যাক্টিভ হয়েছে। এখন অনেকটা নেশা হয়ে গেছে।ও ছবি আঁকে আগে থেকেই, ছেড়েছে অনেক বছর আগে।একদিন একটা ছবি এঁকে এফ বি তে পোস্ট করে। দারুণ সাড়া মিলে।ঐ থেকে ছবি আঁকার ঝোঁক টা বেড়ে যায়।
এফ বি তে নবনীতার দু’একজন বন্ধু হয়েছে। মাঝে মাঝে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। তবে কারও সাথে ফোনে কথা বলতে পছন্দ করে না।ওর পোস্টের নিচে একজন কমেন্ট করে তোমার ছবি কথা বলে।ও দেখে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে বেরিয়ে আসে।এভাবেই চলছিল,হঠাৎ কী নিয়ে যেন মেসেঞ্জারে কথা হয় একদিন।
একটা কাজে ময়মনসিংহ আসতে হবে ওকে।ও নবনীতাকে ফোন করে নবনীতার বাসার লোকেশন জেনে নেয়।প্রীতম বলে আমি এলে তোমাকে ফোন দিব।
বুধবার সকালে ফোন এলো আমি আসছি,কোন কাজ রেখ না।নবনীতা ওকে বলে রেখে দেয়।ওরা একে অপরকে তুমি করে বলে,যা নবনীতার স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু নবনীতার প্রীতমকে অপরিচিত লাগে না।খুব বেশি সময় লাগেনি প্রীতমের আসতে।নবনীতার বাসা থেকে বাস স্টপেজ কিছুটা দূরে।তোমার সাথে দেখা করবো কোথায় আসব বলো?তুমি মাত্রই এলে কাজ তো শেষ করনি।তোমার সাথে দেখা করা আমার কাজ।আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।নবনীতা আকাশ থেকে পড়ল।আমি কোন রেষ্টুরেন্ট এ বসব না গ্রামের দিকে যাবো।
তুমি ব্রাহ্মপুত্রের পার যাও আমি আসছি।পারবে যেতে?সে পারব,তুমি এসো,দেরি করোনা। নবনীতা চটকরে রেডি হয়ে গেল।ওর পিসিকে বলল আসতে দেরি হবে তুমি খেয়ে নিও।চারটে পারোটা, খাসির মাংস রান্না করা ছিল ওটা, এক বোতল পানি,ছোট্ট একটা চায়ের ফ্লাস্ক, একটা বিছানার চাদর নিয়ে বিপাকে পরে গেল।একটু কষ্ট হচ্ছে সেদিকে মন দিল না নবনীতা।
বিশ মিনিট ধরে প্রীতম দাঁড়িয়ে আছে,কিন্তু বিরক্ত লাগছে না।নদীর হাওয়া বেশ ভালো লাগছে।নবনীতা হুড়মুড় করে রিক্সা থেকে নামতে যেয়ে ফ্লাস্কটা পড়ে গেল।নবনীতার মন খারাপ হলো চা খেতে পারবে না।প্রীতম ফ্লাস্কটা তুলে বলল তুমি কি পাগল, এতো কিছু কেন এনেছ?ঝামেলা করবে বলে না বলে এসেছি,কী লাভ হল?
অদ্ভুত ব্যাপার হলো ক্লাস্কটা ভাঙ্গেনি। নৌকা করে ওপারে যাব।কয়েকজন মাঝি এলো মেডাম কোথায় যাবেন চলেন।সারাদিনের জন্য নৌকা ঠিক করছে।এ নৌকায় মাথার উপর ছাউনি আছে।একেবারে ছোট নৌকা নেয়নি কারণ ওরা কেউ সাঁতার জানে না।
নৌকায় উঠে চাদর বিছিয়ে বসে পড়ল।দুজনে চুপচাপ কোন কথা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর একসাথে বলে উঠলো চা নিবে?দুজনেই একটু অবাক হলো।
প্রীতম সব খুলে বলল।আমার স্ত্রীর বেবি হতে যেয়ে মারা যায়।ওর না শশী,রাখীই রেখেছে নামটা।আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিল।হয়তো থাকবেনা বলেই।প্রীতম আর কোন কথা বলছে না।নবনীতা বুঝতে পেরেছে প্রীতমের মন খারাপ লাগছে। বাদ দাও–।প্রীতম আবার বলতে লাগলো শশীর বয়স ছয় বছর।আমি কখনো ভাবিনি কারো সাথে আমার এভাবে কথা হবে।
তোমার কথা বলো।নবনীতা চুপ করে আছে।ওর এসব বলতে ভালো লাগে না।প্রীতম আবার বলল রাখী খুব ভালো গান গাইত। তাই আমি গান শুনতে পারি না,চোখে পানি আসে।নবনীতা বুঝতে পারে ও ওর বউকে খুব ভালোবাসত,এখনো বাসে।ও ভাবে রাখী কত ভাগ্যবান।
গল্প করতে করতে ওরা দুপুরের খাবার সেরে নেয়।নবনীতা বলল কিযে ভাল লাগছে আজ নদীতে বেড়াতে এসে। কতদিন বাইরে ঘুরতে আসি না। দেখতে দেখত সন্ধ্যা হয়ে এলো। প্রীতম বললো নদীতে আমরা সূর্যাস্ত দেখব। নদীতে ওরা সূর্যাস্ত দেখে রওনা দিল নবনীতা প্রীতম কে বাসায় যেতে বলেনি এরপর যখন আসবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে বাসায় আসতে বলবে এভাবে ওদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে এগুতে লাগলো।
নবনীতা কিছুতেই এই ভ্রমণটা কে ভুলতে পারছে না । নবনীতার ভালোবাসার ক্ষুধা যেন তীব্র বেগে বেড়ে চলেছে। ও প্রীতম কে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছেনা কিন্তু প্রীতম কে বলতে পারছে না। ও চায় প্রীতম ওকে কিছু বলুক। নবনীতা সংসার পাততে চায়, ভালোবাসতে চায়, কিন্তু প্রীতম ওর বউকে খুব ভালোবাসত এখনও বাসে ভুলতে পারেনি ।নবনীতার ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা ও কখনই ভালোবাসা পাইনি। শুধু সন্দেহ আর বিকৃত রুচির একটা কুৎসিত চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
প্রীতমকে দেখার আগে কখনও এমন মনে হয়নি।ও প্রীতমের বুকে লেপটে থাকতে চায়।ভর দুপুরে খুনসুটিতে মেতে উঠতে চায়।বিলীন হতে চায় একে অপরের মাঝে। মেতে উঠতে চায় আদিম উন্মত্ততায়।
প্রীতম খুবই সংযমই।নবনীতার কাছে ও এমনি ছুটে আসেনি কিন্তু ওর মেয়ে শশীকে নিয়ে ওর ভীষণ চিন্তা। নবনীতার সাথে শশীর এডজাস্ট হবে কী না এ নিয়ে খুব বেশি ভাবছে প্রীতম।
নবনীতা বসে পত্রিকা পড়ছে।মোবাইল ফোনটা বেজে চলেছে। মোবাইল ধরে একটু অবাক হয়।প্রীতমের ফোন,তোমার সাথে কথা আছে সামনা-সামনি বলতে চাই।
প্রীতম আসবে,নবনীতা ঘর দোর গুছিয়ে রেখেছে।এবার ওকে বাসায় আসতে বলেছে।প্রীতমের আসতে আসতে এগারোটা বেজে গেলো। নবনীতা ওর পিসির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।প্রীতমের বাবার বিজনেসটা প্রীতম এখন দেখে।
প্রীতম আর নবনীতা বসার ঘরে বসেছে।একটা কথা বলতে ছুটে এসেছি তুমি কিভাবে নিবে জানিনা।আমি চাই তুমি আমাদের বাসায় কিছুদিন থাক।তোমার আর শশীর মধ্যে একটা বন্ডিং তৈরি হোক।নবনীতা কেমন চমকে উঠলো। প্রীতম বলল তুমি না চাইলে আমি জোর করবো না।নবনীতা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল ভেবে দেখি।দুপুরে খেয়ে প্রীতম চলে গেলো।
নবনীতার পিসি প্রথমে আপত্তি করেছিল পরে নবনীতার কথা ভেবে রাজি হয়।নবনীতার মাথায় ছিলো না ঢাকায় গেলে আগে ব্যাংকে যোগাযোগ করে ঢাকায় পোস্টিং দিতে অনুরোধ করতে হবে।পনের দিনের মধ্যে ঢাকায় পোস্টিং পেয়ে গেলো।নবনীতা আগেই বলেছে পিসিকে অন্য কোথায়ও রাখতে পারবে না।
নবনীতা ঢাকায় চলে এলো।শশী নবনীতাকে পছন্দও করে না,অপছন্দও করে না।খাবার টেবিলে রোজ দেখা হয়।অন্য সময় শশী নবনীতাকে এড়িয়ে চলে।নবনীতা ওকে মাতৃস্নেহের আচলে রাখতে চায়।শশী আন্টি ডাকে।নবনীতা মনে মনে চায় মা ডাকুক।কিন্তু এতে কোন তাড়াহুড়ো নেই নবনীতার।
হঠাৎ একদিন শশীর খুব জ্বর হয়।ডেংগু ধরা পড়ে।নবনীতা বিচলিত হয়ে পড়ে।শশীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।নবনীতা ছুটি নিয়েছে,ওই হসপিটালে থাকে।নবনীতার মধ্যে প্রীতমকে নিয়ে তেমন উন্মাদনা নেই আর।ও যেন শশীর মা হতে এসেছে।প্রীতম অবাক চোখে দেখে নবনীতাকে আর ভাবে ও এতো ভালো কেন?
একসপ্তাহ হাসপাতাল থেকে শশী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। শশী নবনীতাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।নবনীতা শশীকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে চেয়েছে; তাই হতে চলেছে।প্রীতম বললো নবনীতা কাল একটু তোমায় নিয়ে বেরুব।
এদিকে শশী আর ওর বাবার মধ্যে কথা হয়েছে।শশী বলেছে বাবা তুমি আন্টিকে বিয়ে কর।এ ব্যাপারে নবনীতা কিছু জানেনা।
নবনীতা আর প্রীতম বেরিয়েছে।প্রীতম একটা শপিং মলে ঢুকেছে।নবনীতা বলল এখানে কেন এসেছ?শশীর শরীর ভালো নেই বেশি দেরি করতে পারবো না।প্রীতম বলল শশীকে পেয়ে তো আমাকে ভুলে গেলে।নবনীতা একটু লজ্জা পেল,সত্যিই গত এক সপ্তাহ প্রীতমের কোন খোঁজই ও রাখেনি।
ঠাট্টা করছিলাম বলল প্রীতম। প্রীতম একটা শাড়ীর দোকানে ঢুকেছে।এই এখানে কী করছ তুমি, শাড়ি কিনবে নাকি?কার জন্য? প্রীতম চুপ করে আছে, এটা দেখ,কেমন হয়, আগে বলো কার জন্য?শাড়ি, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে সব কিনলো।এবার নবনীতা বুঝতে পেরেছে।
প্রীতম কোর্টের মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে।আগেই সব ঠিক করা ছিল নবনীতা আর প্রীতম স্বাক্ষর করে বাসায় আসে।এসে দেখে শশী, পিসি,আরও কিছু আত্মীয় স্বজন বসে আছেন।তখনও ওর মনে শশীকে নিয়ে ভয় ছিলো।
শশী এগিয়ে এসে বলে মামনি এসো।নবনীতা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।