আজ ফকির লালন শা্হ-এর ১৩১তম প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
লালন (জন্ম: ১৭৭২ – মৃত্যু: ১৭ অক্টোবর, ১৮৯০)[২] ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি;যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত।[৩] তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক।তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন।লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৪][৫] তার গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।[৬]
লালন ফকির
সাঁই, শাহ (ফার্সি ভাষায় سای)
লালনের জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র, ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্ম লালন চন্দ্র কর
১৭৭২
অবিভক্ত বাংলা[১]
মৃত্যু ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ (১১৬ বছর)
ছেউড়িয়া, কুষ্টিয়া, অবিভক্ত বাংলা
মৃত্যুর কারণ বার্ধক্য
সমাধি ছেউড়িয়া, কুষ্টিয়া
২৩°৫৩′৪৪″ উত্তর ৮৯°০৯′০৭″ পূর্ব
জাতিসত্তা বাঙালি
পেশা সাধক, গায়ক, গীতিকার, সুরকার
যে জন্য পরিচিত বাউল গান, মানবতাবাদী দর্শন
ধরণ বাউল গান
উপাধি ফকির, মহাত্মা, বাউল সম্রাট
ধর্ম অজ্ঞাত
দাম্পত্য সঙ্গী বিশাখা
লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী।যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন।অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন।[৭] তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,[৮][৯][১০] কাজী নজরুল[১১] ও অ্যালেন গিন্সবার্গের[১২] মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে।তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে।[৭] গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।[১৩]
জীবনী
দর্শন সম্পাদনা
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।।
“”
— লালন , দেহতত্ত্ব
লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য।লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ।তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন।[৩০] তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে।তিনি বিশ্বাস করতেন মনের মানুষের কোন ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ, কূল নেই।মানুষের দৃশ্যমান শরীর এবং অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন।সকল মানুষের মনে ঈশ্বর বাস করেন।[২১][৩১] লালনের এই দর্শনকে কোন ধর্মীয় আদর্শের অন্তর্গত করা যায় না।[৩২] লালন, মানব আত্মাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়, অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্তা রূপে।খাঁচার ভিতর অচিন পাখি গানে তিনি মনের অভ্যন্তরের সত্তাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সাথে, যা সহজেই খাঁচা রূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না।[৩৩][৩৪]
লালনের সময়কালে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।[২১] সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ।[৩৫][৩৬] আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে বহু শিষ্ট ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়েছিলেন ।
আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেছিলেন।তার সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।[১৯] লালনের বেশ কিছু রচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন।ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।[৩৫][২১][৩৭] তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না।মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ।আর এই দর্শন প্রচারের জন্য তিনি শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন।লালনকে অনেকে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রদায়িক পরিচয় দিয়ে।কেউ তাকে হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন।লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির ( আরবি “সাধু”) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ
“লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন – আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”[৩৮]
যদিও তিনি একবার লালন ‘ফকির’ বলেছেন, এরপরই তাকে আবার ‘বাউল’ বলেছেন, যেখানে বাউল এবং ফকিরের অর্থ পারস্পরিক সংঘর্ষপ্রবণ।
বাউল দর্শন সম্পাদনা :
বাউল একটি বিশেষ লোকাঁচার ও ধর্মমত।লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৪][৫] বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে।বাউল গান যেমন মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ।বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন[১৯][৩৯] এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস।[৪০] বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ।২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।[৪১]
বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক।[১৯] তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন।বাউল মতবাদের মাঝে বৈষ্ণবধর্ম এবং সূফীবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।[৪২] বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে।[৪৩] তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়।[৪৪] আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন।সাধারণত অশিক্ষিত হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন।[৪৫] বাউলরা তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন।[৪]।
২২৭ বার পড়া হয়েছে