অলিখিত নিয়ম
জেরিন বিনতে জয়নাল (ঠাকুরগাঁও)
১৫ বছর বয়সী কিশোরীর বিয়ে হলো ২৫ বছর বয়সী যুবকের সাথে।
সপ্তাহ না পেরুতেই শ্বাশুড়ির আবদার নাতি-নাতনীর মুখ দেখার,যাওয়ার আগে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিলো যে, সে মরার আগে যেন নাতি-নাতনীর মুখ দেখে যেতে পারে।
সকাল বিকাল তার একটাই যপনা ‘মনে হয় মরার আগে নাতি-নাতনীর মুখ দেখে যেতে পারবো না, আল্লাহ ভাগ্যে সে সুখ রাখে নাই।’
মাস পাঁচেক পেরুতেই কিশোরী জানতে পারলো তার কোল জুড়ে আসতে চলেছে ছোট্ট একটি প্রাণ।
সবাই বেজায় খুশি তবে খুশির সাথে এবার যুক্ত হলো নতুন আবদার, নাতি-নাতনী থেকে নাতনী কাটা পড়ে শুধু নাতি রয়ে গেলো। উনার একটা নাতির খুব শখ, নাতি হওয়া চাই-ই চাই।
গর্ভকালীন সময়ে তার যে পরিমাণ যত্ন-আত্তি এবং ভালো খাবারের প্রয়োজন ছিলো তার ছিটেফোঁটাও সে পায়নি। সবাই মুখে মুখে ভালোবাসা দেখিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে।
প্রসবের সময় আসতে আসতে আমাদের কিশোরী আজ ষোড়শীতে পরিণত হয়েছে কিন্তু তার পরিচয় এসবে নয়, তার পরিচয় হলো কারো বাড়ির বউ এবং অনাগত সন্তানের মা।
প্রসব বেদনা সইতে না পেরে হাসপাতালের কথা বললে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন তার শ্বাশুড়ি এবং অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ।
-এহনকার মাইয়াগোরে বেদনা উঠলেই ডাক্তোর ডাক্তোর করে, হাসপাতালে দৌঁড় দেয়, কই আমরা যে এতোগুলা পোলাপান জন্ম দিলাম হাসপাতাল তো দূর ডাক্তোরের মুখও দেখলাম না।
– ঢংয়ের শ্যাষ নাই আজকালকার মাইয়াগোরে, এমন ভাব দেহায় জানি ওরা ছাড়া আর কারো বাচ্চা হয় না।
– আমরা তো দশ-বারো বছরে বিয়া কইরা বছর না ঘুরতেই পোলাপান নিছি তাও কিছু হয় নাই এহন বুড়ি হইয়া বিয়া বসে তাও যতো তাল-বাহানা।
দাঈ মা আসলো, সুন্দর ভাবে বাচ্চা প্রসব হয়ে গেলো। নাতির মুখ দেখে সবাই খুশি, বিধ্বস্ত সেই ষোড়শীর দিকে কারো তাকানোর সময় নেই।
তার খোঁজ নিয়েই বা কি হবে? সে একজন মেয়ে, বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা জন্ম দেয়া তার কর্তব্য। আহামরি কিছু করে ফেলেনি যে তাকে নিয়ে লাফালাফি করতে হবে কিংবা তার খেয়াল রাখতে হবে।
নাতি হওয়ার আনন্দ উৎসবের নিচে দাবা পড়ল আতুর ঘর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ।
সেখানেও যে একটা প্রাণ ছটফট করছে সে খেয়াল কারো নেই, আসলে সে খবর রাখার প্রয়োজন দেখছি না।
ঘন্টা দুয়েক বাদে আনন্দ উৎসবে ভাটা পড়ল, কোন কাল মুখো যেন খবর দিলো আতুর ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো, উদ্দেশ্য হাসপাতাল।
শত কথার মাঝেও কিছু কথা ভেসে আসলো সদ্য হওয়া মায়ের কানে।
– এমন কি আমাদের হয় নাই? আমরা কি মইরা গেছি? শুধু শুধু হাসপাতালে নিতাছে। একটু পরে এমনেই ঠিক হইয়া যাইবো।
হাসপাতালে পৌঁছাতে চলে যায় অনেকটা সময়, ডাক্তার দেখে অবস্থা শোচনীয়। দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রক্ত,স্যালাইন, বিভিন্ন ইঞ্জেকশন পুশ করা হয় এবং পরিবারকে জানানো হলো ইন্টারনাল ব্লিডিং এর জন্য এ অবস্থা, আরও আগে আনেনি কেন?
দূর থেকে কে জানি বলল, এগুলা কিছুই না ডাক্তারের ব্যবসা, আসলে কিছুই হয় নাই, কিছু টাকা কামাই করবে এই আর কি, আমি হইলে জীব্বনে আনতাম না হাসপাতালে।
দু-তিন ঘণ্টা অতিক্রম হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে, তা দেখে ডাক্তার বলে দিলো এখানে সম্ভব না বড় হাসপাতালে নিতে হবে।
প্রায় মাঝ রাত, বড় হাসপাতালে যেতে সময় লাগবে ২.৫-৩ ঘন্টা, অনেক টাকার ব্যাপার, সবকিছু চিন্তা করে কেমন জানি চুপ হয়ে গেলো সবাই। শুধু চুপ হতে পারলো না তার বাবা।
একাই ছুটাছুটি করে সব ব্যবস্থা করলেন, গাড়িতেও তুললেন রওনা দিলেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে, তবে পৌঁছানো হলো না।
মাঝ পথ থেকেই ফিরে আসতে হলো সবার, মেয়েটি নাকি বড্ড অভিমান করেছে, জেদ ধরেছে চোখ না খোলার, জেদ ধরেছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার, কারো ডাকে সাড়া না দেয়ার।
পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মেয়েটি দূর অজানায় পাড়ি জমিয়েছে সাত দিন যাবৎ।
শ্বশুর বাড়ির প্রায় সবাই ভুলে গেছে, তারা ব্যস্ত মেয়েটির বাবার ঘাড়ে দোষ চাপাতে।
এই তো সেদিন এলাকার মহিলাদের সাথে গল্প করছিলো, কিভাবে মেয়েটির বাবা তার অসুস্থ, দূর্বল মেয়েটিকে উনার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়েছিলো।
কিভাবে তার বাবার জোর করে বড় হাসপাতালে নেয়ার নামে মেয়েকে মাঝ রাস্তায় হত্যা করে তার ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা, ভাগ্যিস তারা বুদ্ধিমান তাই বেঁচে গেছে।
শুনলাম ছেলেটির জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে আবারও, বাচ্চাটার দেখা শোনার জন্য একজন মানুষ দরকার। উনার ছেলে কী আর সামলাতে পারে? সেও তো ছোট মানুষ।
ঘটককে বলেছে ১৬-১৮ বছরের মাঝে মেয়েকে খুঁজতে, খুব বেশি হলে ২০ এর বেশি হলে কিন্তু চলবে না, তাদের ছেলে একদমই ছোট মেয়ে বড় হলে ছেলের পাশে মানাবে না।
বিশেষ খেয়াল রাখতে বলেছে মেয়ের অন্য কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে কি না সেদিকে।
মেয়েটির বাবা প্রতি মুহূর্তে আফসোস করে তার ফুলের মতো মেয়ের জীবন নিজ হাতে নষ্ট করার জন্য, কবরের পাশে বসে কাঁদে কিন্তু সে কান্না কেউ শোনে না, এখন যে কেঁদে কোনো লাভ নেই।
ইশ! পৃথিবী কত সুন্দর, তার চেয়েও বেশি সুন্দর পৃথিবীর এই অলিখিত নিয়মগুলো।