৫০ বছর পরে আজও বাংলা-বাঙালির হৃদয়জুড়ে অরুণ চক্রবর্তীর
“লাল পাহাড়ির দেশে যা” গানটি।
এই লোকগীতিটি শোনেননি, এমন বাঙালি অল্পই আছেন। এটি মূলত একটি কবিতা। লিখেছিলেন কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী, ১৯৭২ সালে। কবিতাটির শিরোনাম ছিল─ ‘শ্রীরামপুর ইস্টিশনে মহুয়া গাছটা’:
শ্রীরামপুর ইস্টিশনে মহুয়া গাছটা,
হাই দ্যাখো গ’ তুই ইখানে ক্যানে?
লালপাহাড়ির দেশে যা,
রাঙা মাটির দেশে যা,
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’, ইক্কেবারেই মানাইছে নাই।
অ-তুই লালপাহাড়ির দেশে যা।
সিখান গেলে মাদল পাবি,
মেইয়ে মরদের আদর পাবি।
অ-তুই লালপাহাড়ির দেশে যা,
লারবি যদি ইক্কাই যেতে,
লিস্ না ক্যানে তুয়ার সাথে;
নইলে অ-তুই মরেই যা,
ইক্কেবারেই মরেই যা,
হাই দ্যাখো গ’, তুই ইখানে ক্যানে?
লালপাহাড়ির দেশে যা,
রাঙা মাটির দেশে যা,
রাঙা মাটির থানে যা।
বছরখানেক পর, কবিতাটিতে সুরারোপ করে একে গানে রূপান্তরিত করেন ভারতের বাঁকুড়া জিলার গায়ক সুভাষ চক্রবর্তী। পরের ক’বছর, সুভাষ চক্রবর্তী বিভিন্ন জায়গায় গেয়ে এই গানটিকে জনপ্রিয়তা এনে দিলে, ১৯৭৬ সালে প্রখ্যাত সুরকার ভি. বালসারা গানটির সঙ্গীতায়োজন করে রেকর্ড করান। এরপরেই গানটি পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অত:পর, গানটি বাউলেরাও গাইতে আরম্ভ করেন। কিন্তু, গীতিকবিতাটি বাউল গানের জন্য কিছুটা অদীর্ঘ হওয়ায়, তাঁরা এটিকে আরেকটু দীর্ঘ করে লিখে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে যান কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তীর কাছে। কবি অরুণ কবিতাটি দীর্ঘায়িত কলেবরে পুনরায় লিখে একে গীতিকবিতা বা গানে পরিণত করেন, এবং বাউলদের সহযোগিতায় নিজেই নতুন আঙ্গিকে এতে সুরারোপ করেন। ঠিক এ-কারণেই গানটিকে বর্তমানে দু’টি ভিন্ন সুরে গাওয়া হয়।
কবি অরুণ চক্রবর্তী গানটির শিরোনাম দেন─ ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’:
লাল পাহাড়ির দেশে যা,
হাই দ্যাখো গ’ তুই ইখানে ক্যানে?
অ তুই লালপাহাড়ির দেশে যা,
রাঙা মাটির দেশে যা,
হেথাকে তুকে মানাইছে লাই রে।
লাল পাহাড়ির দেশে যাবি,
হাঁড়িয়া আর মাদল পাবি,
হেথাকে তুকে মানাইছে লাই রে।
নদীর ধারে শিমুল গাছ,
নানা পাখির বাসা রে, নানা পাখির বাসা,
কাল সকালে ফুইট্বে ফুল,
মনে কতো আশা রে
মনে কতো আশা।
সেথাকে যাবি প্রাণ জুড়াবি,
মাইয়া-মরদের আদর পাবি।
হেথাকে তুকে মানাইছে লাই রে,
ইক্কেবারেই মানাইছে লাই রে।
ভাদর আশ্বিন মাসে,
ভাদু পূজার ঘটা রে, ভাদু পূজার ঘটা,
তুই আমারে ভালোবেসে পালিয়ে গেলি,
কেমন ব্যাপের ব্যাটা রে, কেমন বাপের বেটা!
মরবি তো মরেই যা,
ইক্কেবারেই মরে যা,
হেথাকে তুকে মানাইছে লাই রে,
ইক্কেবারেই মানাইছে লাই রে।
এর পর থেকে এ-গান বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী গেয়েছেন, গাইছেন। এবং, এঁদের অনেকেই গানটির গীতিকার হিসেবে অরুণ কুমার চক্রবর্তীর নাম উল্লেখ করেননি। এই অভ্যাসটি শিল্প-চুরির পর্যায়ে পড়ে। পরবর্তীতে অনেক সঙ্গীতশিল্পী বা সঙ্গীতগোষ্ঠী, যেমন─ ভূমি ব্যাণ্ড সহ আরও অনেকে, পরবর্তীতে মূল তথ্য জানতে পেরে, বা গ্রামগঞ্জের শ্রোতাবৃন্দের ও শিল্পীর অনুসারীদের চাপে পড়ে প্রকৃত গীতিকারের নাম উল্লেখ করেছে বা উল্লেখে বাধ্য হয়েছে। অনেক সোশ্যাল মিডিয়া গোষ্ঠী গানটির গীতিকার হিসেবে নিজেদের প্রিয় গায়কগায়িকার নাম নিজেরা-নিজেরাই বসিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করেছে, যেমন─ অর্ণব সহ আরও অনেকের নাম (এসব জানতে পেরে, ভূমি, অর্ণব এবং অনেকে তাঁদের অসাধু শ্রোতাদের এহেন অসাধুবৃত্তির প্রতিবাদ করেছেন বলেও জেনেছি, যা এই উল্লিখিত শিল্পীদের ও শিল্পসংগঠনগুলোর সুন্দর মানসিকতার পরিচয় নিশ্চয়ই)। অনেক সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার তো গানটির চৌর্যবৃত্তিতে এককাঠি সরেস! তারা নিজেদের গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্রে এই গীতিকবিতাটি এমন টেকনিকে ব্যবহার করেছে, যাতে পাঠক ও দর্শকের মনে হয়─ এ-গান ওই সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টেরই রচিত, অথবা তাদের রচিত না-হলেও এ-গান অরুণের নয়! এমন চৌর্যবৃত্তির একটি প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন সোশ্যাল মিডিয়া, যেখানে প্রতিনিয়ত মূলত একজনের লিখা সাহিত্য, আঁকা শিল্প, সাংস্কৃতিক সৃষ্টি, ইত্যাদিকে নিজের ও নিজের পছন্দের অন্য কারও নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। এ এক নির্লজ্জ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাণ্ড! আমি নিজেও এর শিকার। হা হতোস্মি!
শিল্পচুরি হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ─ এ-বোধ জাগ্রত হোক।
তথ্যসূত্র:
০১. ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা: কবিতার জন্মবিজ্ঞান’─ অরুণ কুমার চক্রবর্তী