১৯০ বার পড়া হয়েছে
অবুঝ ভালোবাসা
শিরীনা ইয়াসমিন
মর্জিনা বাবা মরা মেয়ে।বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে।মর্জিনা অনেকটা বেখেয়ালি,নানীর কাছে থাকে,সারাবছর সর্দি লেগে থাকে;নিজের শরীরের যত্ন নিতে বুঝে না।ছয় বছর বয়সে ওকে কাজে দেয়া হয়।ও মেশিনের মত দ্রুত কাজ করে।কিছু চাইলে সাথে সাথে হাজির।দুবছর এক বাসায় কাজ করে আমার বাসায় আসে।আমার মেয়ের বয়স চার ওর আট।
প্রথম দিকে তেমন কাজ করাতাম না। বাচ্চার সাথে খেলতো।বছর তিনেক যাওয়ার পর ও সব কাজই করে।মাঝে মাঝে লাপাত্তা হয়।ও না আসলে বুঝতাম কাপড় জমেছে।বহু খুঁজে ওকে আনতে হতো। এভাবেই চলছিল,তখন আমার দ্বিতীয় বেবি পেটে আসে।ওকে ছাড়া ভাবতে পারতাম না,কারণ ওর মতো কাজ কেউ করতে পারে না।ও গান ছেড়ে না দিলে কাজ করতে পারত না।আমি সেই স্বাধীনতা ওকে দিয়েছিলাম।
২০০৫ সালে আমার ছেলে পৃথিবীর আলো দেখে।চারদিন পর কুরবানির ঈদ। বেবিকে নিয়ে বাসায় চলে আসি।মা ঈদের জন্য বাড়ি গেছেন।ঈদের দিন সকাল এগারোটা বাজে বাসায় কোন রান্না নেই, মর্জিনা উধাও। বহু খোঁজাখুঁজির পর জানলাম টংগী মায়ের কাছে গেছে।
এখানেই ঘটনার শুরু। ঈদের দুদিন পর ও ফিরে আসে সঙ্গে রুকু।বস্তিতে এলে সবায় ধরে বিয়ে পড়িয়ে দেয়।বিয়ে হওয়ার পর জানতে পারি, আমি কিছুই করতে পারিনি।আরও দুদিন পর ও বাসায় আসে,বলে আমরা ঘুরতে গেছিলাম কিন্তু বস্তিতে আইছি পরে সবাই জোর কইরা বিয়া পড়ায় দিছে বলে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলো।
ও কাজ ছাড়ে না।দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে যায়।আজ পালায় কাল পালায় এভাবেই চলছিল।হঠাৎ বিপত্তি ও বমি করছে ডাক্তার দেখিয়ে কনফার্ম হলাম ওর পেটে বাচ্চা।বাচ্চার পেটে বাচ্চা আমার মাথা ঘুরতে লাগল।বিয়ের পর ওর আর ঠান্ডা লাগে না,আমি অবাক হলাম।ওর একটা ছেলে হল।
বাচ্চা পেটে আসছে পরেই শুরু হলো রুকুর টালটি বালটি।প্রথমে আমাকে জানায়নি,ও তখন আর কাজ করে না।এ সময় ছবি নামে আর একটা মেয়ে কাজ করে আমার বাসায়। হঠাৎ একদিন ও এসে বলে খালা রুকু ছবিকে বিয়ে করেছে।মর্জিনা নির্বিকার ও দুঃখ পেল কিনা কিছুই বুঝা গেল না।ছবি তখনও আমার বাসায় কাজ করে। ছবির সাথে মর্জিনার কোন ক্লেশ নাই ওরা পাশাপাশি থাকে।ওর যা মারামারি হয় রুকুর সাথে।
মাস না যেতে ছবিরও বাচ্চা পেটে আসে।ছবির বাচ্চা পেটে এলে একদিন শুনি রুকু আর বাড়ি ফিরে না।তখন আমি বুঝতে পারলাম রুকু কেন বাড়ি ছেড়েছে।নিম্ন শ্রেণির মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হলো শারীরিক সম্পর্ক। বাচ্চা পেটে এলে কিছুটা গ্যাপ পড়ে সম্পর্কে,এজন্যই ও বারবার বিয়ে করে।
কিছুদিনের মধ্যেই রুকু বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে। ছবির ফুটফুটে একটা বাচ্চা হয়।কিন্তু বাচ্চাটা হঠাৎ মারা যাওয়ায় ছবি ভেঙে পড়ে।
আমার ভাবনা তখন অন্য জায়গায়।রুকুকে কেন মেয়েরা বিয়ে করে? যথেষ্ট পাগল হয়ে বিয়ে করে। কোন কাজ করে না তারপরও।
তিন নম্বর বউয়ের যখন বাচ্চা পেটে তখন ছবির ভাইয়েরা ছবিকে ছাড়াছাড়ি করিয়ে ফেলে।
কিছু দিন যেতেই রুকু আবার পালায়।
বছর খানেক পর ফিরে আসে।তখন বুঝতে পারলাম রুকু আবার নিশ্চয়ই বিয়ে করেছে।ধারণা সত্যি হলো।ঐ বউয়ের পেটে বাচ্চা দিয়ে ও ফিরে আসে।মর্জিনাকে অনেক বুঝানোর পরও ও রুকুকে ছাড়ে না।
রুকুর কোথায় সমস্যা বুঝতে পারলাম।বাচ্চা পেটে এলে শারীরিক মিলনে সমস্যা হয় তখনই ও এ কাজ করে। বারবার একই ঘটনা তবুও মর্জিনা ওকে ছাড়ে না শুধু তাই নয় ছবিকে ছাড়ার সময় যে টাকা দিতে হয়েছে তা মর্জিনাই যোগার করে দেয়।
মর্জিনা তখন আবার আমার বাসায় কাজ করে। মর্জিনা আকলিমা নামে একটা মেয়েকে আমার বাসায় কাজে দেয়।ও গার্মেন্টসে চাকরি নেয়।আমি তখন ঐ বাসা ছেড়ে ফ্ল্যাট এ চলে আসি।কিছুদিন পরে ও আকলিমাকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাট এ আসে,আর বলে রুকুর সাথে আকলিমার প্রেম, আমি আকাশ থেকে পড়লাম।আকলিমাকে বললাম তুই এতোকিছু জেনে কিভাবে এই কাজ করছিস?মেয়েটা এতোটাই ছোট যে কোনো জ্ঞান বুদ্ধি হয়নি।আমাকে উত্তর দিলো আমি ভালোবাসি রুকুকে।আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম।
ভাবছি রুকুর মধ্যে কী আছে মেয়েরা কেন পাগল হয়ে বিয়ে করে। কোন কুলকিনারা পাই না ভেবে।
ঘটনা পরম্পরায় যা ঘটার তাই ঘটল,আকলিমা রুকু পালিয়েছে।কিন্তু এবার ওরা এক সপ্তাহ থাকতে পারেনি।রুকুর বিরুদ্ধে অভিযোগ নাবালক মেয়ে নিয়ে পালিয়েছে। বিচার করে জরিমানা করল ত্রিশ হাজার টাকা।এ টাকাও মর্জিনাই যোগার করে দিল।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করি ভালোবাসা কাকে বলে?
মর্জিনা ওর তিন নম্বর সতীন পাশাপাশি রুমে থাকে।ওরা দিন ভাগ করে নিয়েছে। মর্জিনার কাছে পনের দিন বাকি দিন ওর সতীনের কাছে থাকে।আমি আবাক হয়েছি ওদের সতীনে সতীনে কোন ঝগড়া হয় না।
দিন কাটতে থাকে, মর্জিনার আর একটা ছেলে হয়।হঠাৎ একদিন মর্জিনা বাসায় আসে।আমারে কিছু টাকা দেন ওরে একটা অটো কিনা দিমু।আমি বললাম ওতো অটো বেঁচে পালাবে।মর্জিনা বলল খালা ও ভালো হইয়া গেছে।মন সায় না দিলেও পাঁচ হাজার টাকা দিলাম।রুকুর বাবা গরু বিক্রি করে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছে।
যা ঘটার তাই ঘটলো রুকু গাড়ি বিক্রি করে পালিয়েছে। আমি ধারণা করেছি ঐ-যে নারায়নগঞ্জে একটা বিয়ে করে রেখে এসেছে নিশ্চিত ওখানে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ঐ বউয়ের কাছে গেছে।
টাকা ফুরালে রুকু বউ নিয়ে ফেরত আসে।ঐ মেয়েটা শুনলাম ভালো বেতনে গার্মেন্টসে চাকরি করে। এখানে এসে এসব দেখে মেয়েটা কেমন করে যেন বিদেশে চলে যায়।
মর্জিনা আবার এলো,আমি বুঝতে পারছিনা এবার কেন এসেছে। ও ইনিয়ে বিনিয়ে বললো একটা মোবাইল আছে পুরানো, স্মার্ট ফোনে থাকলে আমারে দেন।রুকু বলছে ফোন দিলে আর ওই বউয়ের কাছে যাবে না।ওর কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম।
রুকুর প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। এভাবেই চলছিল,হঠাৎ শুনি মর্জিনা পালিয়েছে আর একটা ছেলের সাথে। এবার আর ভাবতে পারছিনা,কী হচ্ছে এসব।
নাটকীয়তা এখনও বাকি।রুকু ওকে খুঁজে বের করে ডিভোর্স করিয়ে এনে আবার বিয়ে করে। এমন বৈচিত্র্যময় চরিত্র আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।ওরা এখন সংসার করছে,মর্জিনার বাচ্চা বড় হয়ে গেছে।ওর সতীন ও পাশাপাশি থাকে।রুকু এখনো মাঝে মাঝে উধাও হয়।মর্জিনা ওর সতীনকে নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে আসে।দেখি আর ভাবি জীবন কাকে বলে।ওর কোন সমস্যা হলে এখনও আমার কাছে ছুটে আসে।
মর্জিনা ওর শশুর শাশুড়ীর সেবা যত্ন করে। ওদের পেটের ছেলে ওদের ফেলে যায় মর্জিনা ফেলে যেতে পারেনা।
আল্লাহ পৃথিবীতে কত বিচিত্র মানুষ সৃষ্টি করেছেন।ওদের না দেখলে জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু অজানা থেকে যেতো।
তবে রুকু আমার কাছে রহস্যময় চরিত্র হিসাবেই রয়ে গেল।খুব ইচ্ছে করে ওর সাথে এ বিষয়ে কথা বলি।বলা হয়না,সময় হয় না।তবে মজার একটা ব্যাপার হলো রুকু আমার বাসায় এলে মিষ্টি নিয়ে আসে।আমি মর্জিনাকে সন্তানের মতো দেখি ওটা ও জানে।রুকুও যেনো আমার বাড়িকে শশুর বাড়ি ভাবে।সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ওর বাচ্চারা আমায় নানী ডাকে।ওদের জন্য ঈদের সময় আমি আজও জামাকাপড় কিনি।
আমার বাসায় কাজ করা তিনটা মেয়েকে ও বিয়ে করেছে এটাও আমার কাছে একটা রহস্য। এ রহস্যের এখনও কোন কুল কিনারা পাইনি।পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ ঘটনার কোন কারণ জানা যায় না।
এখনও ওরা একসাথে আছে,ওরা ভালো থাকুক।